
অনন্য আমিনুল ইসলাম
বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের বিকাশ পর্যায়ে যে কজন শিল্পী অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মেধা ও মননে তাঁর হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে চিত্রকলার নুতন পথ। বাংলাদেশের চিত্রকলায় আধুনিক পথ নির্মাণেও তাঁর অবদান অনেক। তবে এখানে একজন শিল্পী আমিনুল ইসলামই কেবল নন, ব্যক্তি আমিনুল ইসলামের জীবনও তাঁর আঁকা ছবির মতো বর্ণিল এবং বৈচিত্র্যময়। ২০১১ সালে গত হয়েছেন বরেণ্য এই শিল্পী। তাঁর বর্ণাঢ্য শিল্পী ও ব্যক্তি জীবন নিয়ে আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘অনন্য আমিনুল ইসলাম’ নামে বইটি। মূলত সাহিত্য সাময়িকী ‘কালি ও কলমে’র বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাগুলো নিয়েই এ-গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। তবে এর বাইরে আরো কয়েকটি লেখা এখানে সংযোজিত হয়েছে।এই বইয়ের সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন আনিসুজ্জামান, এ জেড এম আবদুল আলী, রুবী রহমান ও লুভা নাহিদ চৌধুরী। বইটিতে দেশের অগ্রগণ্য চিত্রশিল্পী, লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবীসহ মোট ত্রিশজন এই বরেণ্য মানুষটিকে স্মরণ করেছেন। এছাড়া এই বইয়ে গ্রন্থিত হয়েছে আমিনুল ইসলামের মৌলিক তিনটি লেখা ও একটি সাক্ষাৎকার।
আমিনুল ইসলামের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন আরেক বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। বন্ধুকে স্মরণ করে তিনি লিখেছেন ‘আমার জীবনে আমিনুল’ শিরোনামে। এই লেখায় শিল্পী আমিনুল ইসলামের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব, তাঁর কাছ থেকে ছবি আঁকা শেখা, বাংলাদেশের চিত্র আন্দোলনের সাথে তাঁদের যুক্ত হওয়া, ইতালিতে যাওয়ার পর তাঁদের মধ্যেকার পত্রযোগাযোগসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। এই লেখায় মুর্তজা বশীর ‘বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার ভুবনে চিরন্তনী নক্ষত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আমিনুল ইসলামকে। ‘বৈরী স্রোতের শিল্পী আমিনুল’ শিরোনামের আরেকটি লেখায় কিংবদন্তি কাইয়ুম চৌধুরী স্মরণ করেছেন আমিনুল ইসলামকে। সেখানে আমিনুল ইসলামের ব্যক্তিত্ব কিভাবে তরুণ শিল্পীদের প্রভাবিত করেছে তা নিয়ে বলতে গিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী লিখেছেন, “আমাদের চোখে আমিনুল তখন হিরো। আমাদের আদর্শ। তার ছবি, সাজপোশাক আমাদের অনুকরণীয় হয়ে উঠল।” শিল্পী আমিনুল ইসলামকে বিমূর্তধারায় ছবি আঁকার পথিকৃৎ হিসেবে উল্লেখ করে বিজন চৌধুরী, লিখেছেন, “বাংলাদেশে বিমূর্তধারায় ছবি আঁকায় আমিনুল কিন্তু পথিকৃৎ। তাকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে ওখানে অনেক শিল্পী বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন।” তবে আমিনুল ইসলাম বিমূর্ত ছবি আঁকলেও তাঁর ছবি মোটেই শেকড় বিচ্ছিন্ন ছিল না। এ প্রসঙ্গে বিজন চৌধুরী লিখেন, “গভীর অভিনিবেশে ওর ছবিগুলো দেখলে বাঙালি জীবনের দৈনন্দিনতা তথা বাঙালি পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রভাব অনুভব করা যায়।” আমিনুল ইসলামকে একজন অসামান্য শিল্পী হিসেবে জেনেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকও। ১৯৬৯ থেকে ২০১১ – এই দীর্ঘ সময়ে আমিনুল ইসলামের সাথে ছায়া হয়ে ছিলেন তাঁর স্ত্রী রুবী ইসলাম। ‘আমিনুলকে যেভাবে দেখেছি’ শিরোনামীয় লেখায় তিনি স্বামী আমিনুল ইসলামকে “অত্যন্ত সাদাসিধে উদার মনের অধিকারী, সব রকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে” একজন মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেইসাথে শিল্পী হিসেবে নিখাদ এবং দেশ, সমাজ এবং রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধ একজন মানুষকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন রুবী ইসলাম।এই গ্রন্থ মূলত শিল্পী আমিনুল ইসলামকে স্মরণ করে প্রকাশিত। এখানকার প্রতিটি লেখা শিল্পী এবং মানুষ আমিনুল ইসলামকে আমাদের সামনে নতুনভাবে উন্মোচিত করে। যেখানে একজন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী, বন্ধু এবং মানবিক মানুষকে আমরা আবিষ্কার করি। সেই সাথে এই বইয়ে আমিনুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার, তার তিনটি মৌলিক প্রবন্ধ এবং সবশেষে যুক্ত ছবিগুলোও পাঠককে আমিনুল ইসলামকে আরেকটু গভীরভাবে বুঝতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।