অন্তর্দাহ
‘অন্তর্দাহ’ এমন একটি উপন্যাস, যেখানে লেখক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক চিত্রও তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে তিনি বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবনের প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ঈর্ষা, দ্বেষ, শ্রেণিগত অসমতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন নানা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে। মঞ্জু সরকার উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ‘অন্তর্দাহ’। এই ‘অন্তর্দাহ’ যেমন ব্যক্তিমানুষের, তেমনি গোটা বাংলাদেশেরও। একদিকে দখলদার বাহিনীর সঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর যুদ্ধ, অন্যদিকে সমাজের ভেতরে বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মধ্যকার লড়াই। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ অন্যান্য স্বার্থ-দ্বন্দ্ব হয়তো সাময়িক চাপা দিয়ে রেখেছিল; জাতীয়তাবাদী আবেগ সমগ্র জনগোষ্ঠীকে আলোড়িত করেছিল; কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তার অনেকটাই টুটে গেছে। আকারে-প্রকারে এটি একটি বড় উপন্যাস। এর রয়েছে অনেক চরিত্র, বহু ঘটনা ও দৃশ্যপট। লেখক সমাজস্থিত মানুষগুলোর সাহস ও বীরত্বের পাশাপাশি ব্যর্থতা-দুর্বলতার দিকটিও সমানভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি কারো প্রতি অযাচিত বীরত্ব আরোপ করেননি, কাউকে হেয় করতে চাননি। একই সঙ্গে ধর্ম ও জাতি-নির্বিশেষে আক্রান্ত-অসহায় মানুষগুলোর প্রতি তাঁর সহজাত সহমর্মিতাও লক্ষ করা যায়।
উপন্যাসের সূচনা একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনকে নিয়ে, যখন ঢাকায় মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোতে সবাই বিজয়ী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে মিছিল নিয়ে যেত; তিনিও সবার সঙ্গে সাধ্যমতো কথা বলতেন; যাকে চিনতেন কাছে নিয়ে বসাতেন। এরকমই একজন ছাত্রনেতা আরিফ। ভিন্ন সংগঠন করলেও ৩২ নম্বরে গিয়ে শেখ মুজিবের স্নেহধন্য হন তিনি। তাঁর সঙ্গেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মানিক ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর তাঁর জন্ম। দাদা আদর করে নাম রেখেছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ মানিক, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার নামে। মানিক রাজনীতির ধারেকাছে ছিলেন না। তাঁর বাবা সজব ভূঁইয়া আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা, নানা কাজি আফতাব মুসলিম লিগার এবং পাকিস্তানের ভক্ত। মানিকের এক মামা বিহারি নারীকে বিয়ে করেছেন। এটা যেন একটি পরিবারের নয়, সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র। এই বিভক্তি সবসময় আদর্শগত নয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত স্বার্থতাড়িত ছিল।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে মানিক রংপুরে তার গ্রামের বাড়ি রতনপুরে চলে যান; তার বাবা সজব ভূঁইয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, তার নেতা মশিয়ার রহমান এমএনএ, যিনি স্বাধীনতার পর মন্ত্রী হবেন; কিন্তু মানিকের নানা বনেদি মুসলিম লিগার এবং বহু বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। শ্বশুর ও জামাতার মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট। একাত্তরের উত্তাল মার্চে মানিক গ্রামে ফিরে গিয়ে যুবকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন; তাদের নিয়ে কুন্ডা ব্রিজ ভেঙে দিয়ে সেনাবাহিনী আসার পথ বন্ধ করে দেন। ঠাংভাঙা হাটে গিয়ে দোকানে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলেন। মুসলিম লীগার নানাকে অপমান করেন।
কিন্তু ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযানের পর দ্রুত সবকিছু বদলাতে থাকে; রংপুর শহর পর্যন্ত সেনাবাহিনী আসে। সে-সময় অবরুদ্ধ ও অসহায় গ্রামবাসী স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে ফের চাঁদতারা পতাকা উত্তোলন করেন। মানিকের নানা হন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। এটাও ছিল কঠিন বাস্তবতা। মানিক গ্রামের বিত্তবান পরিবারের সন্তান; তাদের আশ্রিত ও ফাইফরমাশখাটা বাংকু ও তার সঙ্গীরা মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলে তিনি অনেকটা একা হয়ে পড়েন। অনুশোচনায় ভোগেন। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে হিন্দুপাড়ার পরেশ কাকার পরিবারের সঙ্গে ভারতে রওনা দেন তিনি; কিন্তু পথিমধ্যে পরেশকাকা পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী মালতী ও তাদের শিশুসন্তানকে নিয়ে কোচবিহার শহরে মামার বাসায় আশ্রয় নেন। উপন্যাসে মানিক ও মালতীর সম্পর্কটি অমীমাংসিত (অবশ্য সব মানব সম্পর্কই চূড়ান্ত বিচারে মীমাংসার ঊর্ধ্বে)। মানিক মালতীর প্রতি দুর্বলতা ঢেকে রাখতে পারে না এবং কোচবিহারে মামার বাড়িতে এক রাতের ‘অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার’ পর তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। মশিয়ার এমএনের সহায়তায় ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিলেও মানিকের আর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হয় না। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও পান না। তার আগেই পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং দেশ স্বাধীন হয়। মঞ্জু সরকার তাঁর উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও বেশি মনোযোগ দিয়েছেন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, স্বাধীনতার আগে সমাজের যে-অংশ নেতৃত্ব দিত এখনো তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। কেবল চরিত্রগুলো বদলেছে। কাজী আফতাব চেয়ারম্যানের স্থলে এসেছেন সজব ভূঁইয়া। তিনি শ্বশুরকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন মানবতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়, সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার আশায়। মানিক এসব অন্যায়-অত্যাচার মেনে নিতে পারেন না। তিনি গ্রামের যুবকদের সংগঠিত করে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন; কিন্তু তাতেও বাধা হয়ে দাঁড়ান তার বাবা, যিনি সরকারি ত্রাণসামগ্রী গরিব মানুষকে না দিয়ে নিজেই হজম করেন। আর মুক্তিযোদ্ধা বাংটুরা আগের অবস্থায়ই আছেন, মিলিশিয়ায় ঢুকতে না পেরে বেকার জীবনযাপন করছেন, আগের ভূঁইয়াবাড়ির চাকরের কাজও করতে পারছেন না। মুখে তালাক বলা ঢোঁড়াইয়ের স্ত্রীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার দুঃসাহস দেখান মুক্তিযোদ্ধা বাংটু; কিন্তু সমাজ তা মেনে নিতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা বাংটুর লাশ আবিষ্কৃত হয় বিলে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশে যে-বিশৃঙ্খল পরিবেশ ছিল, যে-আদর্শহীনতা সমাজকে গ্রাস করেছিল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে ‘অন্তর্দাহ’-এ। বিশাল ক্যানভাসে রচিত এই উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন যে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষে মানুষে যে-বৈষম্য, সমাজজীবনে যে-অচলায়তন, তা ভাঙা সম্ভব হয় না। মানিক এখানে নায়ক নন; পর্যটক। সময়ের পর্যটক হিসেবে তিনি সবকিছু অবলোকন করেন; যে-মানিক স্বাধীনতাবিরোধী নানাকে চড় মারতে দ্বিধা করেননি; সেই মানিকই তাকে বাবার চক্রান্ত থেকে বাঁচাতে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন।