
আমগ্ন কাটাকুটি খেলা
স্থাপত্যবিদ্যা, সাহিত্য, শিল্প এবং সংস্কৃতি – এই চার ধারাকে নিজের ভেতর ধারণ করেছেন আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পরিচিত মুখ কবি রবিউল হুসাইন। ‘বিষুবরেখা’র কবি রবিউল হুসাইন তাঁর আগের কাব্যগ্রন্থগুলোর মতো ‘আমগ্ন কাটাকুটি খেলা’তেও রেখেছেন মৌলিক কবি প্রতিভার স্বাক্ষর।
আধুনিক ইংরেজি কবিতার অন্যতম পুরোধা পুরুষ টি.এস. ইলিয়ট কবিতায় আবেগের বাড়াবাড়ির দিকে ভ্রূকুটি করেছেন। পূর্বসূরি রোমান্টিক কবিদের প্রতি ইলিয়টের কড়া সমালোচনা, ব্যক্তিক অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা । কাব্যরস কখনো ব্যক্তি অনুভূতির বাইরে যেতে পারে না, কিন্তু ইলিয়ট তাতে এক ধরনের নির্মোহ অভিব্যক্তি আরোপের পক্ষপাতী । ইলিয়টের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমালোচনা করে পাতার পর পাতা এবং বইয়ের পর বই লেখা যেতে পারে, কিন্তু কবি রবিউল হুসাইন যে প্রায় একই ভাবনা মাথায় রেখেছেন ‘আমগ্ন কাটাকুটি খেলা’-র কবিতাগুলো রচনার সময়, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ভিন্নধারার এই কবি শৈল্পিক হাতে লাগাম টেনেছেন আবেগের, আবেগকে বল্গাছাড়া হতে দেননি কবিতার কোথাও। অত্যধিক আবেগময়তার যে ব্যাধি বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতায় প্রায়শই দেখা যায়, ‘আমগ্ন কাটাকুটি খেলা’ তার ছোঁয়াচমুক্ত। কাব্যপ্রেমীকে নির্মোহ অনুভব এবং পরিমিত আবেগের এক জগতে নিয়ে যেতে সক্ষম রবিউল হুসাইনের এই সৃষ্টি ।
আবেগের লাগাম টানার কথা এলেও ‘আমগ্ন কাটাকুটি খেলা’-র একটা বড় অংশ জুড়ে আছে কবির স্মৃতিচারণ । যে পথ পেরিয়ে এসেছেন, সত্তরোর্ধ্ব এই কবি বারবার ফিরে চেয়েছেন সেই দিকে। নস্টালজিয়ার অন্তহীন সাগরে ডুব দিয়েছেন, কিন্তু ডুব দিয়ে বুঁদ হয়ে যাননি, সেই সাগরের তলদেশ থেকে তুলে এনেছেন উপলব্ধির উজ্জ্বল মুক্তো, যা বেশির ভাগ সময়েই বিষাদমাখা । তাই ‘আমগ্ন কাটাকুটি খেলা’ কেবল কবিতারই নয়, এটি একইসাথে লিপিবদ্ধ পার্থিব অভিজ্ঞতা এবং জীবনদর্শন । বইয়ের প্রথম কবিতাটিই শুরু হয়েছে শৈশবের এক চিরপরিচিত চিত্র দিয়ে, অত্যন্ত সাবলীল বাংলায়, ‘আমার এক পেয়ারা কাঠের/ লাটিম ছিলো ছোটবেলার’ আর কবিতার শেষাবধি তা গিয়ে ঠেকেছে জীবন সম্পর্কে এক অ্যাবসার্ডিস্ট উপলব্ধিতে – ‘মধ্যবৃত্তে মৃত্যুবধি ঘুরছি আমি অবিরত’। কখনো কখনো নস্টালজিয়া কিংবা ব্যক্তিক অতীত নয়, মানুষ এবং সমাজ সম্পর্কে সত্য উঠে এসেছে পরাবাস্তব অক্ষরে, যেমনটা এসেছে নামকবিতায়, ‘ছাদের ওপর অভয়ারণ্য/ নিচের খাঁচায় কাকাতুয়া গৃহবধূ ধর্মগ্রন্থ/ অন্যায়-প্রীতি প্রচল চিন্তাচেতনা’। সমাজের নানা অসংগতি, ব্যর্থ বিদ্রোহের কথাও উঠে এসেছে বইয়ের ৫৪টি কবিতার অনেকগুলোতেই ।