
আশ্বিনের শেষ রাত্তিরে
‘একদিকে আড়িয়াল খাঁ আর অন্যদিকে ভুবনেশ্বরকে যুক্ত করা একটা ক্ষীণ বাহু চৈতারকোল। কোলের আঁকাবাঁকা গতিপথ ধরে গ্রামটা ধনুকের মতো বেঁকে গড়ে উঠেছে। গ্রামের পেছনে ফসলি মাঠ, সেই মাঠ পার হয়ে চোখে পড়বে কাঁচারডাঙ্গী। কোলপাড় থেকে কাঁচারডাঙ্গীর তটরেখা যতটা চোখে পড়ে, কোলের ওইপারে ফসলের মাঠ পেরিয়ে পরের গ্রাম অনেক ধূসর।’
বদরুন নাহারের ‘আশ্বিনের শেষ রাত্তিরে’ উপন্যাসের এ-বর্ণনা পড়েই বুঝে নেওয়া যায় গাঁও-গেরামের নিষ্কণ্টক জীবনালেখ্যকে উপজীব্য করেছেন লেখক। পুরো বই শেষ করে এই বুঝ আরো পোক্ত হয় যে, সহজ গ্রামীণজীবনের নিখুঁত-বিস্তৃত বর্ণনা এবং চরিত্রের মনস্তত্ত্বানুগ সংলাপ উপন্যাসের মূল সম্পদ। কৃষিজীবী গ্রাম্য লোকাচারের আনন্দের মধ্যে বেড়ে ওঠা চরিত্রগুলোর মানসিক টানাপড়েনের দিকেও তীক্ষè নজর দেওয়া হয়েছে উপন্যাসটিতে।
উপন্যাস বা ছোটগল্প শুরু করার ক্ষেত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আকস্মিক শুরুর যে-টেকনিক ব্যবহার করেছেন বদরুন নাহারকে তার প্রতিই বিশ্বস্ত দেখা যায়। ‘ময়নার একটা ভাল সম্বন্ধ এসেছে। বাড়ি ভদ্রাসন, ছেলেটি শিক্ষিত।’ চমৎকারভাবে শুরু করে লেখক এগিয়েছেন চৈতারকোলের প্রভাবশালী গেরস্থ মিয়াবাড়ির কন্যা ময়নার বিলম্বিত প্রেম-বিয়ে-মানসিক টানাপড়েন ও সংসারী হওয়ার আখ্যানের পরিণতির দিকে। একে উপন্যাসে রূপ দিতে চৈতারকোলপাড়ের মিয়াবাড়ি ও আশপাশের গ্রামের বেশ কিছু চরিত্র তুলে আনা হয়েছে। কালো হওয়ার অপরাধে ময়নার বিয়ে-বিলম্ব, লজিং মাস্টার লিয়াকতের প্রেম-রাজনীতি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকালে নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে রাজনীতির হাওয়া, বাম রাজনীতিতে দীক্ষিত বাতেন মাস্টারের রাজনীতিহীন সংসারজীবন, বাউল-মানসিকতার আলা মিয়ার বাউন্ডুলেপনা, ময়নার স্বামী লেবু খাঁর বোকামিময় জীবনকে বশে আনতে হয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে কৃষিজীবী গ্রামীণ সমাজের আশ্বিনের শেষ রাত্রের বিলীয়মান লোকাচার গাশ্শি সংস্কৃতি। গ্রামীণ জীবনের এই লোকাচার শহুরে সংস্কৃতির আবহে বিলীয়মান এক অজানা উৎসবে পরিণত। চরিত্রগুলোর ওপর ভর করে গ্রামীণ মিথটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন লেখক।
নিখুঁত বর্ণনার উদাহরণ রয়েছে এ-উপন্যাসের পরতে পরতে। চাঁদনী রাতে উঠোনে ধান মাড়াই চলে, গল্পগুজবের আসরে মেতে ওঠে গ্রামের মানুষ। এ্রর বর্ণনা নিতান্ত গ্রামীণ, বাস্তবানুগ ও নিটোল।
কাহিনি ও চরিত্রচিত্রণের অনুল্লেখযোগ্য সামান্য বিচ্যুতি সত্ত্বেও এ-উপন্যাসের ভাষাভঙ্গি, চরিত্রের প্রেক্ষণবিন্দু অনুসারে সংলাপযোজনা, গ্রাম-প্রকৃতির নিটোল বর্ণনা, জীবনযাপনের মনস্তত্ত্ব, প্রাত্যহিক ঘটনাসৃজন ও নির্ভেজাল গ্রাম্য ভাষাভঙ্গি দিয়ে তা সমাপন উপন্যাসকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনের এমন একটি উৎসব-গাশ্শিকে পুনরুজ্জীবন করা হয়েছে, যা আজ বাংলাদেশ থেকে বিলীন হতে চলেছে। স্বভাবতই উপন্যাসটি সুখপাঠ্য ও শিল্পসফল।