
কাইয়ুম চৌধুরী: স্মারকগ্রন্থ
কাইয়ুম চৌধুরী: স্মারকগ্রন্থ। গ্রন্থটি অতীব যত্নের সঙ্গে সম্পাদনা ও গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলি সংকলন করেছেন আবুল হাসনাত।
কাইয়ুম চৌধুরী দীর্ঘ ষাট বছরের সাধনার মধ্য দিয়ে স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল এক শৈলী নির্মাণ এবং বিষয়ের গুণে নিজস্ব ভুবন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই সৃজনে ধরা আছে বাংলা ও বাঙালির সংগ্রাম, মানুষের মর্মযাতনা, দুঃখকষ্ট এবং ঐতিহ্যিক প্রবাহ। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পী, যাঁর ছবিতে তেমন কোনো বিমূর্তায়নের ছায়া নেই। তাঁর চিত্রচর্চা, জীবনদৃষ্টি ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকার তাঁকে একজন প্রখর সমাজসচেতন শিল্পী করে তুলেছিল। তিনি কতভাবে যে তাঁর পটে ঐতিহ্যিক ভাবনাকে আধুনিক বোধ ও ভাবনায় পুনর্নির্মাণ করেছেন, তা বলে শেষ করা যায় না। এই ঐতিহ্যিক প্রবাহে নিমজ্জিত হয়ে বাংলাদেশের লোকশিল্পের নানা অনুষঙ্গ থেকে পরিগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তিনি বাংলার এই লোকশিল্পের মধ্যে সৃজনের সমৃদ্ধ ভাবানুষঙ্গ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই বিষয়কেই তিনি আধুনিক বোধে ও নিজস্ব শৈলীতে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এক্ষেত্রে শিল্পীর যে জিজ্ঞাসা ও দেশভাবনার প্রকাশ আছে তা নবীন প্রজন্মকে শিল্প-সৃজনে প্রাণিত করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
এই স্মারক গ্রন্থটি অনেক গুণীসহ কাইয়ুম চৌধুরীর কাছের মানুষের মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণমূলক রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে।
কাইয়ুম চৌধুরীকে নিবেদিত সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা দিয়ে শুরু হওয়া বইটিতে কাইয়ুম চৌধুরী ও তাঁর কর্মময় জীবন নিয়ে লিখেছেন আনিসুজ্জামান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, প্রণবরঞ্জন রায়, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, অমিতাভ সেনগুপ্ত, নজরুল ইসলাম, সুশোভন অধিকারী, রফিকুন নবী, বুলবন ওসমান, রামেন্দু মজুমদার, রাতুল দেববর্মণ, মতিউর রহমান, জাহিদ আকবর চৌধুরী, দেবব্রত চক্রবর্তী, মালেকা বেগম, আবুল মনসুর, আবুল মোমেন, মফিদুল হক, সুশান্ত মজুমদার, সৈয়দ আজিজুল হক, মামুন কায়সার, হারিসুল হক, রশীদ আমিন, জাফর আহমদ রাশেদ, অশোক কর্মকার, রফি হক, হাসান হাফিজ, আবুল হাসনাত এবং কাইয়ুম চৌধুরীর পুত্র মইনুল ইসলাম জাবের।
সকল মাধ্যমেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বিশেষত তেলরং, জলরং, গোয়াশ, প্যাস্টেল ও অ্যাক্রিলিকে করা তাঁর অজস্র কাজে তিনি যে বৈশিষ্ট্যের ও শৈলীর ছাপ রেখে গেছেন, তা এদেশের চিত্রকলায় অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এমনকি তাঁর রেখালেখ্যও হয়ে উঠেছে দীপ্ত। তিনি গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে মৃত্যুকাল অবধি লব্ধজ্ঞান, অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে এদেশের বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণকে এমন এক উচ্চস্তরে নিয়ে গেছেন, যা হয়ে উঠেছে বিশ্বমানের, শিল্পসুষমামণ্ডিত ও আধুনিকতার প্রকাশে উজ্জ্বল। তিনি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছেন। এসব প্রচ্ছদে বিষয় তীব্রভাবে অর্থময় হয়ে উঠেছে। এছাড়া অসংখ্য নিমন্ত্রণপত্র এবং দীর্ঘবাদনের কয়েকটি প্রচ্ছদেও তাঁর শিল্পিত শক্তিময়তার প্রকাশ আছে। বৈচিত্র্যে ও শিল্পমূল্যে গ্রন্থের এইসব প্রচ্ছদ অসামান্য হয়ে উঠেছে। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রাফিক ও প্রচ্ছদ অঙ্কনের ভুবনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা প্রতিদিন অনুভূত হচ্ছে।
সংস্কৃতির সকল শাখায় তাঁর সহজ বিচরণ ছিল। তিনি কবিতা লিখতেন। কবিতা রচনায় তিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং তাঁর রচিত প্রবন্ধও মৌলিকত্বে ও বক্তব্যে বিশিষ্ট হয়ে আছে। সাহিত্য, সংগীত ও চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর আগ্রহের অন্ত ছিল না এবং এই সকল ক্ষেত্রের শুদ্ধ ও পরিশীলিত চেতনাকে ধারণ করেই তাঁর শিল্প-সৃজন হয়ে উঠেছিল গহন ও গভীর।
মোটকথা কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে এই অবধি লেখা সবচেয়ে ভালো রচনাগুলির একটি সংকলন হচ্ছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত এই বই।