
কালের মান্দাস
‘কালের মান্দাস।’ মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই। মান্দাস শব্দের অর্থ ভেলা বা নৌকো জাতীয় কিছু। আলোচ্য বইটিতে কবির নিজস্ব কালের ভেলা যেন সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে বর্তমানের জয়-পরাজয় কিংবা সংগ্রাম-গ্লানিকে তুলে আনে চিরন্তনের আদলে।
মোহাম্মদ রফিক বাংলা সাহিত্যের ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন। উক্ত দশক থেকে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এই কবি যে আলাদা কাব্যধারা সৃষ্টি করেছেন, তা বলা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। দেশের মানুষের স্বপ্নভঙ্গ ও নিদারুণ জীবনযাপনের কথকতা তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান দিক। আলোচ্য বইটিতে কবি রচনা করেছেন কবিতার পর কবিতায় রূপকথা আর শ্মশানে চিতা জ্বালানোর রূপকথা। তা নিয়ে যায় কবিকে অপার নৈরাশ্যে, কবির মনের নিঃসীম ঔদাস্যে। স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের ভার বয়ে বয়ে আবার পৌঁছানো যায় এমন এক জায়গায়, যেখানে আছে শূন্যতার বুকে অবগাহনের মন্ত্র, বেঁচে ওঠার মন্ত্র। তাই স্বপ্নহীন থেকে স্বপ্নে যাওয়ার কবিতাই পড়ি আমরা কবির এই বইটিতে। এ যেন নিশ্চিত মন্ত্রের ধ্বনি।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসে লেখা ৫৬টি কবিতা সংকলিত হয়েছে ৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে তারুণ্যের যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল, তার উত্তাপ ‘কালের মান্দাস’-এর অনেকটা জুড়েই রয়েছে। যেমন, ‘প্রতিধ্বনি’কবিতাটি সময়ের বেড়া ভেঙে দেয়। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও কবি দেখতে পান একাত্তরের একতার দৃঢ়তা। বইটি এভাবেই পাঠককে পৌঁছে দেয় নতুন জয়ের সম্ভাবনায় ও প্রাণাবেগে। ‘মৃত্যুর পাহাড় ঠেলে উজ্জীবিত মানুষের জয়!’ তখনই আশ্বাস জাগে, এবার ইতিহাসের ভুলগুলি শুধরে যাবে। তাই তো স্বপ্নহীন থেকে স্বপ্নে যাওয়ার কবিতাই কালের মান্দাসে। সেখানে ভয়ের মধ্যেও সাহস ও বিশ্বাসের সঞ্চার ঘটে, শবের ভিড়েও গুনগুন গান শোনা যায়। ‘প্রতিধ্বনি’ কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘ইতিহাস নড়ে বসে সমুদ্রের বিপুল গর্জনে/ সম্মিলিত পদধ্বনি ভাঙে সময়ের ব্যবধান/ কিশোর বালক সেও শোনে উজ্জীবন মন্ত্র/ কণ্ঠে-কণ্ঠে লক্ষ লক্ষ মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাতে/ নবজন্ম ঘটে যায় একটি দেশের জনমানুষের/ এবং তখন কেউ নয় বিচ্ছিন্ন বদ্বীপ বুকে-বুকে/ জ্বলে ওঠে প্রদীপের শিখা চোখে চোখে/ অগ্নিবাণ সম্প্রীতির বিশ্বাসের দৃঢ় অঙ্গীকার/ জয় হবে, হবে জয় শোনো ওই কালের নিনাদ,/ জাগো, ঢেউ উঠছে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ!’
সুন্দর সাবলীল জীবনের আশা ব্যর্থতা হয়ে বাস্তবতা হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। ‘অভাজন’ কবিতায় আমরা পাই সেই বাস্তবতার ললিত রূপ। ‘কালের মান্দাস’-এর কবিতাগুলি রচনাকালেই সমগ্র দেশকে আরেকটি ঘটনা হতবিহ্বল করে তুলেছিল। তা হলো রানা প্লাজার ভয়াবহ ধস ও সেই দুর্ঘটনায় হাজার মানুষের মৃত্যু। এই বইয়ের কয়েকটি কবিতায় ধরা আছে সেই মর্মান্তিক সময়ের কিছু দুঃসহ চিত্র। শাহীনা নামে এক পোশাক-শ্রমিক ধসে পড়া রানা প্লাজা থেকে উদ্ধার পেতে পেতে শেষ মুহূর্তে উদ্ধারকাজের জন্যই জ্বালানো আগুনে পুড়ে মৃত্যুপথে ধাবিত হয়। তাকে নিয়েই এই ‘শাহীনা’ শিরোনামে কবিতাটি লেখা।
বর্তমান ও চিরকালকে মেলাতে খুব কম কবিই পারেন মোহাম্মদ রফিকের মতো। ‘কালের মান্দাস’ বইটিতেও উক্ত বৈশিষ্ট্যের ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই বইটি সমসাময়িক সময়ের নির্যাস ধারণ করে পৌঁছেছে মহাকালের প্রান্তরে। সাম্প্রতিক কালের ঘটনাবলির যথা অর্থে প্রকাশ ঘটেছে বইটিতে।