বেঙ্গল পাবলিকেশন্‌‌স

ঢাকা শহরের ভিখারিদের গান

Price
380 BDT

Published on
February 2022

ISBN
978-984-94823-1-4

Category


আমাদের সংগৃহীত গানের প্রায় সবগুলোই মুসলমান-বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোকে বিষয় বিবেচনায় কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে :

ক. আল্লা ও রসুলের প্রশস্তি ও মহিমা বর্ণনা;

খ. রসুলের মাহাত্ম্য ও তাঁর জীবনের নানা ঘটনার বিবরণ;

গ. হযরত আলী, বিবি ফাতেমা ও হাসান-হোসেনের জীবনকেন্দ্রিক;

ঘ. কারবালা কাহিনি;

ঙ. বেলালের আজান;

চ. ওয়াইজ করনির রসুলভক্তি;

ছ. কয়েকজন নবী ও পিরের জীবন ও অলৌকিক কাজের খ- ঘটনা;

জ. মৃত্যুসংক্রান্ত বিশ্বাস;

ঝ. মারফতি  ভাবধারার গান।

এর বাইরে কয়েকটি গানে রয়েছে গায়ক-ভিখারিদের দৈনন্দিন দুর্দশার চিত্র, সমাজের বৈষম্যের বিবরণ এবং সহানুভূতি অর্জনের প্রয়াস। দুতিনটি গান প্রণয়গীতি ঢঙের।

আল্লাহ-রসুলের প্রশস্তিমূলক গানগুলিতে আল্লাহকে সম্বোধন করা হয়েছে হায়াত-মওতের মালিক, তিনি খাবার দিলে খাই, ভবের দুনিয়া তাঁর লীলা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের প্রতি জোর দিয়ে। পাশাপাশি রহমান, মেহেরবান, অনন্ত, অসীম প্রভৃতি অভিধাও রয়েছে। কিন্তু যখন একজন ভিখারি বলেন যে,

… জনম জনম যদি গাই

 তোমারি মহিমা গাওয়া শেষ হবে না। …

… কখনো যদি ভুলি তোমারে

করুণা তুমি নিও না তুলে… (গান ৫৮)

তখন আশ্চর্যজনকভাবে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের সমজাতীয় চয়নের কথা মনে আসে।  এ ধরনের প্রার্থনাসূচক গান-কবিতা ১৯৫০-৬০ দশকে বহুল প্রচলিত ছিল।

রসুলের-প্রশস্তিতে তাঁকে অধিকাংশ সময় নবী বা নবীজি বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আল্লাহর প্রসঙ্গ  এলেই তাতে রসুলের প্রসঙ্গ যুক্ত হয়েছে। বারবার বলা হয়েছে তিনি হাশরের ময়দানে উম্মতের জামিন হবেন। ভিখারি-গায়ক তাঁর আবেগের কথাও বলেছেনÑ‘নবীজিকে না দেখিলে মন পাগলও হয় আমার’ (গান ৪৭)।

তবে এসবের চেয়ে নবী যে দান-খয়রাতে মশগুল থাকতেন, তার দিকেই গায়কের দৃষ্টি বেশি। দান করলে করব আজাব মাপ হবে, হাশরের ময়দানে প্রবেশে দানিদের দরজা প্রশস্ত হবে, পরকালে দানের প্রতিদান পাওয়া যাবে, দানে হায়াত বাড়ে, প্রভৃতি বলে এর সঙ্গে রসুলেকে যুক্ত করা হয়েছে এভাবেÑ

…একদিন আমার দিনের নবী কইরাছিল দান…

… দিনমজুরি খাইটা নবী খোরমা করে দান … (গান ৪)

আমাদের সংগ্রহের এক-তৃতীয়াংশের বেশি গান রসুলের প্রশস্তিবাচক। ভিখারি-গায়ক নবীর প্রেমে মাতোয়ারা, এদেশে তাঁর মন টেকে নাÑ

… পাখা যদি থাকত আমার

 দেরি তো ভাই করতাম না আর

উড়ে গিয়ে হাজির হতাম নবীজির রওজায় রে… (গান ৬১)

অন্যত্র বলছেন, ‘মদিনারই পথের ধূলি সুরমা বলি চোখে তুলি’ (গান ৬৪);

অথবা

…আমার আকাশের তারা পাতালের বালা নবীজি

 কোথায় আছেন তিনি লুকাইয়া।…

… আকাশও দেখিলাম পাতালও খুঁজিলাম

নবী তোমার দেখা আর পাইলাম না।… (গান ২১)

কিংবা

… তোমারই প্রেমের জ্বালা অন্তর আমার হইল কালা

বুক চিড়িয়া দেখাইতাম পাইলে একবার

উম্মতের কা-ারি তুমি নবী দয়াল

তুমি ছাড়া এ ভুবনে কী আছে আর আমার। (গান ৫৭)

একটি গানের প্রচলিত পল্লিগীতির ছায়া স্পষ্ট :

… পবন খুড়ার নৌকাখানি কি সুন্দর রাংগাইয়াছে

দয়াল নবী আমার নৌকা সাজাইয়াছে। (গান ৪১)

কিছু গানে রসুল সম্পর্কে প্রচলিত পদ্য-প্রশস্তির ছাপ আছেÑ

… নবী মোর পরশমণি…

… নবী মোর নুরে খোদা সে নামে সকল পয়দা

নবীরও নাম ধরিয়া পাখি যায় গান করিয়া

সে নামে মজনু হলো মাওলা আমার গানের ধ্বনি। (গান ২৭)

অথবা

… মদিনাতে ফুল ফুটেছে নবীর ফুল

সেই ফুলেরও নাম রাখছেন আল্লা সেই রসুল। (গান ৯)

বেশ কয়েকটি গানের মূল উপজীব্য রসুলের জীবনের নানা ঘটনার বিবরণ। ভিখারি-গায়কদের দ্বিতীয় গানটিতেই নবীর জীবন সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য আছে। আবদুল্লাহর ঔরসে আমেনার গর্ভে আরব দেশে জন্ম, মাতৃগর্ভে থাকাকালেই পিতৃহারা, শৈশবে মাতৃহারা, হালিমার ঘরে প্রতিপালন, মেষ চরানো, ২৫ বছর বয়সে বিয়ে, ৪০ বছর বয়সে ওহি লাভ, জিবরাইল কর্তৃক ‘সিনা চাক’, হামকাওয়ামের পানিতে গোসল ইত্যাদি পৃথকভাবে বর্ণিত হয়েছে এ-গানে। অন্য একটি গানে (গান ৬৬) আমেনার কোলে জন্ম, জন্মের পর সেজদা, ওহুদের যুদ্ধে দ–শহীদ, তায়েফবাসী কর্তৃক রসুলকে পাথর নিক্ষেপ ইত্যাদির বিবরণ আছে।

দুটি গানে আবু জেহেলের অত্যাচার (গান ৪৬) এবং মদিনা ও মক্কায় নামাজের আহ্বানের (গান ৪৫) প্রসঙ্গ আছে।

কিছু স্বল্প পরিচিত ঘটনা যা মূলত লোকবিশ্বাস, তাও পাওয়া যায়। একটি গানে (গান ২১) দেখা যায় কন্যা ফাতেমা বাবাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। পাহাড়ে রাখালদের বাবার খোঁজ জিজ্ঞাসা করছেন। সাতদিন পর পাহাড়ের মধ্যে ‘উম্মতি উম্মতি’ ডাক শোনা গেল। দেখা গেল, রসুল সেজদায় পড়ে প্রার্থনা করেছেন। নাতি হাসান-হোসেন নানাকে আশ্বাস দিলেন যে, উম্মতের গুনাহ মাফ করতে তারা দোজগে যেতে রাজি আছেন; রসুল সেজদা থেকে উঠলেন। অন্য একটি গানে (গান ৩৬) রসুলের মেরাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ আছে।

ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে রসুলের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-কষ্টও ভিখারি-গায়কদের বর্ণনায় স্থান পেয়েছেÑ

…ভাতের কষ্টে দিন কাটাইলেন সুখের খাবার খাইলেন না

একদিন নবীর ঘুম আসিলেন খেজুর পাতার বিছানা। (গান ২)

রসুল এবং হরিণের বাচ্চার দুধ খাওয়ানো নিয়ে বহুল প্রচলিত গানটিও (গান ২২) এই সংগ্রহে রয়েছে। দেখা যায় যে, হরিণকে ছেড়ে দিয়ে রসুল তার দড়ি নিজের গলায় নিয়ে বসে আছেন, শিকারিরা ফিরে এসে নবীকে অপদস্ত করছেন এবং হরিণী শাবকসহ ফিরে এলে তারা বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন।

নবীর ওফাত নিয়ে দুটি গানের চিত্তাকর্ষক বিবরণ পাওয়া যায়। একটি গানে (গান ৩০) আল্লাহ তাঁর দোস্তকে ডাক দিয়েছেন; আজরাইল এসে তাঁর পায়ের কাছে বসেছেন। রসুল তাঁকে বলছেন যে, জান কবচের সময় তাঁকে কষ্ট দিলেও তাঁর উম্মতকে যেন কষ্ট দেওয়া না হয়। অন্য একটি গানে এই বিবরণ বিস্তৃত এবং কল্পিত (গান ৩৫)। সেখানে রসুল সোরাখানায় বিশ্রামরত; আজরাইল তাঁকে ডাকছেন। কন্যা ফাতেমা আজরাইলের সঙ্গে কথা বলে খানিকটা সময় চাইছেন। আজরাইল তাঁকে তাড়া দিচ্ছেন।

এতসবের পরও ভিখারি-গায়কের দুঃখÑ

…রবিউল আউয়াল এলে তোমারি গান গাই

রবিউল আউয়াল গেলে তোমায় ভুলে যাই। (গান ৬০)

রসুলকে নিয়ে যেসব গান এই সংগ্রহে রয়েছে তার অনেকগুলিতেই হযরত আলী, বিবি ফাতেমা ও হাসান-হোসেনের প্রসঙ্গ আছে। সাফায়াত-দানকারী নবী তাদেরকে নিয়েই ধর্মের পথ দেখানÑ

…শাফায়তের নৌকা গো নবী আল্লা সাজাইয়া

পুলসেরাতের ঘাটে গো রাখলেন বান্ধিয়া।

রুপার টাকা কাগজের নোট নবী নিবেন না

বেনামাজিকে নবীর নৌকায় তুলবেন না।

মা ফাতেমা নায়ের বাদাম আল্লা তুলিয়া

হযরত আলী নায়ের গলায় আল্লা বসাইয়া।

হাসান হোসেন দুই ভাই নৌকার বৈঠারে

দয়াল নবী যাবেন নৌকা বাওয়াইয়া। (গান ৯)

একই ধরনের অন্য দুটি পানের একটিতে (গান ২৯) মা ফাতেমা বেহেশতের কা-ারি, নবী নৌকার মাঝি, হাসান-হোসেন নৌকার বৈঠা; হযরত আলী সেই নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্যটিতে (গান ৪৩) নবী নৌকা সজ্জিত করছেনÑআলী সেই নৌকার মাঝি।

একটি গানে (গান ৪০) হযরত আলী পৃথিবী থেকে বিদায়কালে কাঁদছেন এবং আশা করছেন হাসান-হোসেনকে ‘তোমার নানার উম্মত দিবেন নাতো ফেলে আর’। কিন্তু হাসান-হোসেন বলছেন যে ‘আমার নানার উম্মত হইলেন গুনাগার’। এরপর তারা দামেস্কে এসে ইমামতি দাবি করছেন। হাসান-হোসেন সম্পর্কিত অন্য গানে (গান ৪৮) ফাতেমার বেদনা ও দুঃখের কথা বলেছেন গায়ক। এ-গানে হযরত আবু বকর সিদ্দিকীর উল্লেখ আছে। একটি গানে (গান ৬৩) ফাতেমা প্রসঙ্গে ভিখারি-গায়কই যেন স্মরণ-কাতর :

… বেহেশতেরি  টুকরাখানি ফুলেরো বাগান

 দেখাও মোরে মা ফাতেমা মাজার কোনখান।

মদিনারও কোন পাহাড়ে করত খেলা সঙ্গীর সনে

কোন সে গাছের খেজুরগুলি করতে লুকোচুরি…

…মদিনারো কোনখানে তোর আয়াতে কোরানে

দোলনা দিয়ে ঘুম পাড়াতো হাসান হোসেনে।Ñ

ফাতেমার জীবনের টুকরো কিছু ঘটনা পাওয়া যায় নানা গানে; তবে এর ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। একটি গানে দেখা যায় (গান ৪৮) ফাতেমা সত্তর তালি দেওয়া শাড়ি পরিধান করছেন। অন্য গানে (গান ৭) দেখা যায়, মা ফাতেমা একবার শস্যের গোলা এবং একবার দুধের ছেলেকে বন্ধক রেখে দরিদ্রদের দান-খয়রাত করছেন।

রসুলের প্রিয় দৌহিত্র হয়েও হাসান-হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যু মুসলমানরা কখনো মেনে নিতে পারেনি। শত শত বছর ধরে এ জন্য তারা আফসোস করেছে, হাহাকার করেছে। বাংলাও গড়ে উঠেছে মর্সিয়া সাহিত্যের পৃথক ধারা। এই করুণ মৃত্যুর নানারকম লৌকিক-অলৌকিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে। আমাদের সংগ্রহে এ-সম্পর্কে ফকির-গায়কদের একটি চিত্তাকর্ষক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে, যাকে একটি নতুন থিম হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

এই গানে (গান ৮) দেখা যায়, পবিত্র মক্কার মসজিদে রসুল জানতে চান কার কার বিবি ঠিকমতো নামাজ পড়েন। আবু বকর সিদ্দিকী জানান যে তাঁর বিবি ‘পঞ্চরতœ নামাজ বিবি করে সর্বক্ষণ’। ওসমান গনি জানান যে, ‘সোনা নারী আমার ঘরে’। ওমরের কথা গানে উল্লেখ নাই। এরপর আলীর পালা। এবং ‘হযরত আলী পড়ল ফ্যারে/ফাতেমার নামাজ আলী দেখে নাই তখন’। আলী অস্থির হয়ে ওঠেন, বিছানায়ও ছটফট করছেন এবং একসময় ঊর্ধ্বাংশ বস্ত্রহীন অবস্থায় বেরিয়ে পড়েন। এখানে দেখা যায় যে, আল্লার হুকুমে রফরফ কিছু তত্ত্ব বা খবর নিয়ে এসেছে এবং তাঁকে নিয়ে রফরফ চতুর্থ আসমানে গেল। উল্লেখ্য, এই রফরফে সওয়ার হয়েই রসুল মেরাজ করেন। অন্যদিকে রসুল ইমামতির জন্য মসজিদে চলে গেছেন; বিবি ফাতেমা দরজা-জানলা বন্ধ করে অন্য মসজিদে নামাজ পড়ছেন। আলী উত্তেজিত হয়ে মসজিদের ভেতরের দৃশ্য দেখার জন্য দুই আঙুলে দুটো ছিদ্র করেন। তিনি দেখতে পান যে ফাতেমা পড়ে নামাজ মনেরই মতন’। নামাজের সালাম ফিরিয়ে ‘মসজিদ ছিদ্র দেখতে পায় মা জান্নাতের খাতুন’। তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে পাক নিরঞ্জনে’র কাছে প্রার্থনা করেনÑ

… যে করিল মসজিদ ছিদ্র তার কলিজা হবে ছিদ্র

তার কলিজা হবে ছিদ্র মসজিদের মতন।…

এরপর…

… দয়াল নবী কেন্দে বলে, কি সর্বনাশ করলি মারে

একবারে খাওয়াইলা ইমামও দুইজন।

মা ফাতেমা কেন্দে বলে, শোনো আব্বা কই তোমারে

পুত্রের শোকেতে আমি ত্যাজিব জীবন।

দয়াল নবী উইঠা বলে, শোনো মাগো কই তোমারে

আল্লার খাতায় গেইছে লেখা না যাবে খণ্ডন।

… মাও হইছে পুত্রহারা এই দোষের কারণ…

হাসান-হোসেনের মৃত্যু নিয়ে এই মিথ একেবারেই নতুন বলে আমাদের ধারণা।

বাঙালি মুসলমানের লোকগানের একটা মুখ্য বিষয় কারবালার কাহিনি।

ভিখারি-গায়কদের গানেও কারবালার কাহিনি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে।

একটি গানে দেখা যায় (গান ৩), হোসেনের মৃত্যুর পর পরলোকে ফাতেমার ‘কারবালার আগুন লাইগাছে… কলিজায়’। আল্লার আদেশে জিবরাইল তাঁকে আরশের পাখা দিয়ে বাতাস করছেন। ওদিকে কারবালায়Ñ

… একে একে সবাই গেল কেউ তো ফিরে এলো না

সোনার চান জয়নাল তোমার যাওয়া হবে না।…

‘মহররমের চন্দ্র গো দিনে কি ঘটাইলেন রব্বানা’-র পরিচিত চরণ দিয়ে অন্য একটি গানের সূচনা (গান ১০)। এতে হোসেনের শাহাদাতবরণ, জয়নালের বন্দিত্ব, সখিনার কান্নার পাশাপাশি গায়কের বর্ণনায় ‘বেহেশ্তে লুকাইয়া কান্দে আলী আর ওই ফাতেমা’। অন্য গানে (গান ৪২) হোসেনের মৃত্যুর পর দুলদুল ঘোড়ার মদিনা গমন, গোলাপ দিয়ে গোসল করিয়ে সুরমা ও চাদর দিয়ে হোসেনের মৃতদেশ ঢাকা, খুন্তি-কোদাল-দড়ি দিয়ে কবর তৈরি প্রভৃতি প্রসঙ্গ আছে। তবে এগুলো কারবালার বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিল নেই; গায়ক আপন অভিজ্ঞতা থেকে হোসেনের মৃত্যুপরবর্তী ঘটনা কল্পনা করেছেন।

একটি গানে (গান ১২) পল্লিগীতির ঢঙে কাশেমের যুদ্ধযাত্রার কাহিনি রয়েছে। সখিনার সঙ্গে কাশেমের বিয়ে পড়াচ্ছেন চাচা হোসেন। বিয়ের রাত পার না হতেই কাশেম ফোরাত নদীতে জল আনতে অর্থাৎ যুদ্ধে যাচ্ছেন। ‘ওই রণের কথা শুনেরে কান্দে/কান্দে বিবি সখিনা’Ñযেন বাঙালি বধূর ক্রন্দন। একটি গানে (গান ২৬) এক মুসলিম বালকের কুফা থেকে মদিনা যাত্রায় এজিদের থানায় ধরা পড়ার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বেলালের সুমধুর আজান-ধ্বনি এবং রসুলের মৃত্যুর পর আজান দিতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু নিয়ে আমাদের সংগ্রহে তিনটি গান আছে। একটি গান (গান ১৩) রসুল ও বেলালের মধ্যে কথোপকথন ঢঙে রচিত। রসুলের মৃত্যুর পর বেলাল তাঁকে সন্ধান করছে; গানটিতে মধুর সুরে আজান দেওয়ার প্রসঙ্গ আছে। অন্য গানে (গান ২৩) প্রথমাংশের বিষয়বস্তু আগেরটির মতো। তবে গানের দ্বিতীয় অংশে প্রশ্ন করা হয়েছেÑ

… কার বা বাড়ি কার বা ঘর কার বা কি

যখন ছাড়ি যাইরে রে তোর প্রাণপাখি।…

…সাড়ে তিনহাত জাগায় রইবেন পড়িয়া।…

তৃতীয় গানে (গান ৬৫) বেলালকে আজান দিতে অনুরোধ করলে বেলাল মিনারে উঠতে চায় না; কারণ ‘আমার আজান কে শুনিবে নবী নাই যে দুনিয়ায়’। এতে আজান দিতে গিয়ে বেলালের মৃত্যু হতে পারে, এমন ইংগিত আছে।

রসুল-ভক্ত ওয়াজকরনিকে নিয়ে দুটি দীর্ঘ গান আছে এই সংগ্রহে। ওয়াজকরনি ইয়েমেনের শওর নদী তীরবর্তী করণ গ্রামের বাসিন্দা; তার পিতার নামও আবদুল্লাহ। রসুলের জীবিতকালে ইয়েমেনে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটলে ওয়াজকরনি মুসলমান এবং রসুলের আশিক হন। তাঁর মা বৃদ্ধা এবং অন্ধ ছিলেন। এবং ওয়াজকরনি মায়ের সেবায় ব্যস্ত থাকার কারণে কখনো মদিনায় রসুলের সমীপে আসতে পারেননি। ওয়াজকরনি রসুলের মৃত্যুর পর সিফফিনের যুদ্ধে (৬৫৮ খ্রি.) মুয়াবিয়া বাহিনীর হাতে শহীদ হন।

ওয়াজকরনির জীবনের দুটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। প্রথম, ওহুদের যুদ্ধে তীর লেগে রসুলের  দুটি দাঁত ভেঙে যায়। খবর শুনে ওয়াজকরনি তাঁর নিজের দুটো দাঁত ভেঙে ফেলেন। তখন তাঁর মনে হয় যে, রসুলের কোন দুটি দাঁত ভেঙেছে তা তো তিনি জানে না। এরপর ওয়াজকরনি একে একে তাঁর সবগুলো দাঁতই ভেঙে ফেলেন। দ্বিতীয় ঘটনা, অন্যান্য ভক্তের মাধ্যমে রসুল ওয়াজকরনির কথা জানতে পারেন। হযরত আলীর এক জীবনীকারের বর্ণনা অনুযায়ী রসুল তখন বলেন, ‘যে আমার, আমি তার। আমার জোব্বা ওয়াজকরনি পাবে। হে ওমর ও আলী, আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার পোশাক তাকে দিয়ে এসো।’ আমাদের সংগৃহীত গানে এ-দুটো ঘটনারই উল্লেখ আছে।

প্রথম গানের (গান ১৬) বর্ণনায় দেখা যায় যে, রসুসের পুরুষ সন্তানরা সকলেই সকালে মারা গেছেন। এর মধ্যে রসুল ইহলোক ত্যাগ করেন। ওয়াজকরনি তখন মদিনার পথে নিকটবর্তী এক জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। দ্বিতীয় গানের (গান ১৭) বিবরণ বিস্তৃত। এর প্রথম অংশে দেখা যায়।

… নবী একদিন যুদ্ধে গেলেন দন্তন একটা শহীদ হইলেন

এই কথাটি পাগল শুনে একে একে বত্রিশ দন্তন

ভাঙিয়া ফেলায় গো।…

পরের অংশের বর্ণনা অনুসারে নবীর ইহলোক ত্যাগের পর হযরত আলী নির্দেশ অনুযায়ী জোব্বা দিতে ওয়াজকরনির সন্ধান করেন। শেষ পর্যন্ত ‘ওয়াইজ্জা পাগল’রূপী ওয়াজকরনির দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। তাঁর হাতে জামা দিলে পাগল আলীর পরিচয় জানতে চান। আলী যখন জানায় যে তিনি রসুলের জামাতা, তখন পাগল বলে, ‘নবীজির জামাইও তুমি বিশ্বাস করি না।’ কেননা আলীর সব দাঁত অক্ষত আছে।

আমাদের সংগৃহীত গানে রসুল-পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যে আদম, ইবরাহিম, মুসা, ইউসুফ ও ইউনুস নবীর প্রসঙ্গ আছে। একটি গানে (গান ৪৬) পাওয়া যায় :

… আঠার হাজার মকলুক আছে আর

সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ করলেন তৈয়ার আর

সেই মানুষের অন্তর্যামী আল্লা পাক

পাঠাইলেন আদম হাওয়ায় দুনিয়ার…

একটি দীর্ঘ গানে (গান ২৫) ইবরাহিম খলিলুল্লাহ্ ও ইউনুসের প্রসঙ্গ আছেÑ

… খলিলকে আগুনে দিল নমরুদও বেইমান

জ্বলন্ত আগুনের মাঝে দিলেন আল্লা ফুলবাগান।

… হযরতও ইউনুসেরে বোয়াল মাছে খাইল

তোমার নামে দোহাই দিয়া মরিয়া যে বাঁচিল।…

অন্য একটি গানে (গান ৩৪) আদম, মুসা ও ইউনুসের অলৌকিকতার বিবরণ বিস্তৃতÑ

… তুমি মুসা নবীরে আল্লা দুশমনেরই ডরে

সিন্দুকে ভরিয়া দিলে ভাসায়ে সাগরে

পরান ছিল যাহার ভয় সেথায় পাইল আশ্রয়…

…তুমি মাটির আদমকে প্রথম সৃষ্টি করিয়া

ঘোষণা করিয়া দিলে শ্রেষ্ঠ বলিয়া

তাই নূরের ফেরেশতা করল আদমকে সেজদা…

… যখন ইনুস নবীরে খাইল মাছেতে গিলিয়া

ফেরেশতা পাঠাইয়া দিলে ইসমে আজম দিয়া…

… মাছে পেটো হইতে সে যে পাইল পরিত্রাণ…।

ইউসুফ নবীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে একটি গানে (গান ১৪)। ইউসুফের দশ ভাই মিলে ইউসুফকে কুয়োয় ফেলে দিয়েছে। সাপ-বিচ্ছুতে ভরা সেই কুয়া। কুয়ায় পড়ি কান্দেন ইসুফ হায়রে হায়’; আল্লা তাকে রক্ষা করলেন।

আইয়ুব নবীকে কুষ্ঠ রোগের কারণে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। বিবি রহিমা ভিক্ষা করে তাঁর সেবা করছেন, এমন বর্ণনা পাওয়া যায় একটি গানে (গান ১৮)। মা রাবেয়ার প্রসঙ্গ আছে একটি গানে (গান ৫)।

বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানির অলৌকিক কাজ নিয়ে রচিত হয়েছে একটি গান (গান ৫১)। এর মধ্যে রয়েছে মাতৃগর্ভ থেকে আঠার ছিপাড়া কোরান মুখস্থ, মুর্দার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ইত্যাদি রয়েছে। অন্য একটি গানে (গান ২৫) বড়পির কর্তৃক মেয়েকে পুরুষ করার প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। খাজা আজমেরির প্রশস্তি রয়েছে অন্য একটি গানে (গান ৫২)।

মৃত্যু-পরবর্তী আচার ও সংস্কারের চিত্র আছে বেশ কয়েকটি গানে। একটি গানে (গান ১৫) স্বজন হারিয়ে একা পরলোক যাত্রাকালে ক্রন্দনরত ব্যক্তির আহাজারি শোনা যায়। তাকে শাদা কাপড় পরিয়ে সাড়ে তিনহাত কবরে রেখে সকলে চলে গেছে। অন্ধকার কবরে সাপ-বিচ্ছুর উৎপাত। সওয়াল-জওয়াবের জন্য দুজন কবর খুলল এবং মনকির-নকির ফেরেশতা এলো তখন রোজা-নামাজই একমাত্র ভরসা। অন্য গানে (গান ২০) কবরে বাঁশের খাটনির সারির ওপর মাটি দেওয়া এবং স্বজনদের কান্নার চিত্র আছে। মুর্দাকে কাফন পরানো, কবরে নামানো, বাঁশের খাটনি বিছানো প্রভৃতির প্রসঙ্গ আছে একটি গানে (গান ২৪)।

অন্য একটি গানে (গান ৪৪) পরলোক যাত্রাকে নাইয়র যাত্রার সাজনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এখানে নাইয়রির কাপড় শাদা, যাত্রার গাড়ি নতুন ধরনের, প্রসাধন আতর-গোলাপ। মৃত্যুর সময়ে রিক্ত হাতে যাবার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে একটি গানে (গান ৬)Ñ

… ভবের দুনিয়া ভবে পইড়া থাকবে রে…

…দালান কোঠা সবই ছাইড়া থাকবেন বাবারে…

… খাট-পালঙ্ক সবই পইড়া থাকবে বাবারে…

…সাড়ে তিনহাত মাটির নিচে যাব বাবারে…

… টাকা পয়সা কেউতো সঙ্গে যাইবে না বাবারে…।

মুসলমানদের বিশ্বাসে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন বেহেশত-দোজগ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর আগের পর্বে রয়েছে পুলসেরাতের সেতু অতিক্রম। গায়ক-ভিখারিরা এর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে (গান ৪)Ñ

…পুলসেরাতের রাস্তা হবে তিরিশও হাজার

চুল পরিমাণ রাস্তা হবে হীরার মতো ধার।

নেককার বান্দা পার হইবেন বিজলির আকার

শয়তানও কাইটা পড়বে দোজখের মাঝার।…

ভিখারিদের একগুচ্ছ গানে তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা রয়েছে। তাদের কপাল মন্দ; তাই তারা অন্ধ, ল্যাংড়া, মাজুর। ফলে ‘ভিক্ষার ঝুলি কান্দে করি ঘুরি আমরা নগর-নগরী’ (গান ৬৯)। তাদের বাস্তব অবস্থার বর্ণনাও আছেÑ

…এতো দুঃখ মনে করি ঘুরছি মোরা দেশ-বিদেশ

পড়ে আছি কমলাপুরে আর।

কমলাপুরের মাথার মধ্যে ফকিরখানায় আড্ডা করে

ঢাকা শহর ঘুরে যে তারা।…

কুষ্ঠরোগ সারাতে ও রোগীদের সেবায় দুলাহাজরার নিরাময় কেন্দ্রে ইংরেজ সিস্টারের দরদের চিত্রও পাওয়া যায় একটি গানে (গান ৩৮)। আবার মানুষের মহানুভূতি অর্জনের জন্য তারা নবীর দানের উদাহরণ দেয়, পরকালে দানের প্রতিফলের কথা বলে।

ভিখারিদের কয়েকটি গানে মারফতি-মুরশিদির ছায়া স্পষ্ট :

…মাবুদের নামে নৌকাখানি গলাতে ঝুলালাম…

…ভাঙা তরী মনের সাথে বাইতে আর পাইরলাম না… (গান ৫৩)

অথবা

…আসিলে ভবে যাইতে হবে রে মন থাকবে নাতো কেউ দুনিয়ায়…

…আসিছি একা যাইব একায় মন কেউ তো সঙ্গে মোদের থাকবে না।… (গান ৬৭)

অথবা

এমনো প্রেমের খেলা খেলছ আল্লায়

তুমি আর তোমার দোস্ত দুইজনা।… (গান ৭০)

অন্য একটি গানে পাওয়া যায় বাউল গানের রেশÑ

…যেদিন যাবেন মনের ময়না

মাটির খাঁচা রইবে পইড়া…

…আমার কালো ময়নারে

আমার প্রাণের পাখি রে

একদিন তো যাইবারে ময়না উড়িয়া

একদিন তো যাইবারে ময়না ছাড়িয়া। (গান ৫৩)

সংগৃহীত কিছু গানের গার্হস্থ্য-অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পেয়েছে। এরকম একটি গানে গায়ক বলছেনÑ

বাড়ির শোভা বাগবাগিচা ঘরের শোভা পিরা রে

গোয়াল ঘরের গরু শোভা নদীর শোভা ডিঙা রে।

মায়ের শোভা শিশু সন্তান আঁচল ধইরা টান পাড়ে

গরুর শোভা ক্যাচড়া বাছুর পিছে পইড়া ফাল পাড়ে।

সন্ধ্যার শোভা ঘরের বাতি নারীর শোভা পুরুষ রে… (গান ৭১)

কিন্তু এরপরই গানটিতে দেখা যায় মায়ের জন্য হাহাকার, আল্লার আরশ কাঁপা প্রভৃতি প্রসঙ্গ। তবে সংগ্রহের দুটি গান একান্তভাবেই প্রায় সংগীত। একটিতে প্রণয়িনী বলছেনÑ

… আমি বন্ধুর কলঙ্কিনী কলঙ্ক লইয়া বেড়াই …

… সোনাবন্ধে কি জানে না সই গো

আমার যে কেউ নাই।… (গান ৭২)

অন্যটিতে বাঙালি নারী-হৃদয়ের চিরন্তন প্রকাশÑ

কুকিল গাছের ডালে জাউলায় বাসা

বান্ধি দেখ ঘরে রয়,

কুকিল ডাকিস নারে আর।

তোর ডাকেতে অন্তর জ্বলে কুকিল

সইতে পারি না আর।… (গান ৫৫)

সব মিলিয়ে বলা যায়, আমাদের সংগৃহীত ভিখারিদের গানের বিষয়বস্তু, বাঙালি মুসলমানের দোভাষী পুথির ভাবজগৎ দ্বারা আচ্ছন্ন। এই ভাবজগৎ গড়ে উঠেছিল ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের পাশাপাশি বহু বিশ্বাস-সংস্কারের সমন্বয়ে। ওই বিশ্বাসের সঙ্গে আরবের বিশ্বাস-সংস্কারের বিস্তর ফারাক। কেননা এতে ভারতীয় বা বাঙালির আচার-বিশ্বাস-সংস্কার যুক্ত হয়েছিল। অন্যভাবে বলা যায়, এই জগৎ বাঙালি মুসলমানের লৌকিক ইসলামের জগৎ।

উপস্থাপনার বিবেচনায় বলা যায় যে, এসব গানের সৃষ্টিতে ভিখারি-গায়করা বাংলা লোকসাহিত্য, বিশেষত লোকসংগীত দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। চিন্তা-চেতনার দিক থেকে বাউল-মারফতি-মুরশিদির প্রভাব এতে স্পষ্ট। এর রূপকল্প তৈরিতে গায়করা ব্যবহার করেছেন বাংলার নিসর্গ, বিশেষত নদীমাতৃক প্রকৃতিকে।

এসব গানের প্রধান উদ্দেশ্য ভিক্ষা চাওয়া। ফলে গায়করা মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে ভয়াবহ পরীক্ষা প্রভৃতি উত্তরণে দানের গুরুত্ব তুলে ধরতে সচেষ্ট।

অনেক সময় তারা আবেগী-প্রতারণার (emotional blackmail) আশ্রয়ও নিয়েছেন। আবার তাদের দুর্দশাক্লিষ্ট বাস্তব জীবনের ছবিও কোনো কোনো গানের বিষয় হয়েছে।

বাংলাদেশে বিলীয়মান লোকসংগীতের একটি ধারা ভিখারিদের গান রসের বিবেচনায় দরিদ্র মুসলমানদের ধর্মভাবনার মনস্তত্ত্বকে ধারণ করে আছে ॥



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *