
দুটি উপন্যাস : ভালোবাসার মরণমৃত্যু এবং জীবিত ও মৃতের প্রেম
বিপ্রদাশ বড়ুয়ার উপন্যাস আমাদের সবসময় নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। যে বাস্তবতা ঠিক স্বস্তিদায়ক কিছু নয়। তাঁর উপন্যাস পড়তে পড়তে আমাদের ভেতরেও চলতে থাকে অদ্ভুত এক অর্ন্তদ্বন্দ্ব – ভালো এবং মন্দের। আমরা বুঝতে পারি না, উপন্যাসে যা ঘটছে ঠিক হচ্ছে কিনা? আবার আমরা চাইলেও সেই বাস্তবতাকে খারিজ করতে পারি না। গ্রহণ এবং বর্জনের এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের নৈতিক অবস্থানও ঠিক স্বস্তিতে থাকতে পারে না। এমনকি উপন্যাস শেষ করার পরও, আমরা সেই দ্বন্দ্বের ঘোর থেকে বের হতে পারি না। তেমনই দুটি উপন্যাস ‘ভালোবাসার মরণনৃত্য’ এবং ‘জীবিত ও মৃতের প্রেম’। এই দুটি উপন্যাসকে একই মলাটে বন্দি করে ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘দুটি উপন্যাস’ শিরোনামে বই। উপন্যারদুটির ভাষা এবং বিষয়বস্তু আমাদের ধরে রাখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
প্রেম, কাম, নৈতিকতা, ষড়যন্ত্র, ঘৃণা এবং খুন – মানুষের এইসব প্রবণতা একসাথে এসে জড়ো হয়েছে বইয়ের প্রথম উপন্যাস ‘ভালোবাসার মরণনৃত্যে’। যেখানে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র অদ্ভুত এক অন্তর্দ্বন্দ্বে আক্রান্ত। এই উপন্যাসের আঙ্গিকও বেশ অভিনব। প্রত্যেকটা চরিত্রের স্বগতোক্তির ভেতর দিয়ে এগিয়েছে উপন্যাস। উপন্যাসের কাহিনি ডানা মেলতে শুরু করে আফতাবের স্বগতোক্তি দিয়ে। যেখানে বয়সের বড় বন্ধু বিদেশফেরত আজরতকে খুন করার সিদ্ধান্তের কথা সে জানায়। এই কাজ সে করতে চায় সুখিয়াকে পাওয়ার জন্য। সুখিয়া আজরতের বউ। আজরত প্রবাসে থাকায় ঘনিষ্ঠ হয় আফতাব ও সুখিয়া। কিন্তু আফতাব সুখিয়াকে ভালোবাসে তো? খুন করার সিদ্ধান্ত নিলেও ভালোবাসে কিনা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারে না আফতাব। আবার শেফালিকেও ভালোবাসত আফতাব। এভাবে প্রত্যেকটা চরিত্র তাদের বয়ানে কাহিনিকে এগিয়ে নিতে থাকে। কিন্তু কোবাদ যখন পাটক্ষেতে আফতাবের লাশ আবিষ্কার করে তখন পুরো উপন্যাসের গতিই অন্যদিকে ঘুরে যায়। কোবাদ কিংবা পোস্টমর্টেম করা ডাক্তার কেউই বুঝতে পারে না আফতাব কি আত্মহত্যা করেছে, নাকি হত্যা। এদিকে একই সময়ে উপন্যাসের আরো একটি চরিত্র খুন হয়, সেটি হলো আজরত। প্রেম ও অপ্রেমের দ্বন্দ্বে খুন হয়ে যায় দুটি মানুষ। উপন্যাসের শেষ লাইনটিই হয়তো পুরো উপন্যাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। “সুখিয়া চেয়েছিল তার জীবন থেকে একজন চলে যাবে। চলে গেল দুজন। সেই সঙ্গে নিয়ে গেল এমন সবকিছু যা এতদিন তার নিজের ছিল, গর্ব করত। মানুষ কত তুচ্ছ বিষয় নিয়েও না গর্ব করে যায়।”
পরের উপন্যাস ‘জীবিত ও মৃতের প্রেম’। নামের মধ্যেই এই উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সুর লুকিয়ে আছে। জাদুবাস্তবতার আশ্রয়ে লেখা এই উপন্যাসে মৃতপুরীর কৃষ্ণকমলিকার সাথে বাস্তব জগতের একজনের প্রেম হয়। এই প্রেমের পরিণতি হওয়ার নয়, এই উপন্যাসেও তা হয় না। কিন্তু প্রেমের যে শাশ্বত আবেদন তার পুরোটাই পাওয়া যায় এতে। উপন্যাসের ভাষার ব্যাপারেও বেশ সচেতন ছিলেন ঔপন্যাসিক বিপ্রদাশ বড়ুয়া। শুরুটা অনেকটা কবিতার কাছাকাছি। জাদুবাস্তবতার ক্ষেত্রে ভাষার যে ঘোর প্রয়োজন, তার পুরোটাই তৈরি করতে হয়েছে সক্ষম হয়েছেন ঔপন্যাসিক। সবমিলিয়ে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার এই উপন্যাস দুটি নতুন ধরনের ন্যারেটিভের স্বাদ দিয়েছে পাঠককে।