
নভেরা আহমেদ
আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘নভেরা আহমেদ’ মূলত বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কিছু লেখার সংকলন। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে ষাটের দশকের প্রারম্ভে এদেশের ভাস্কর্য শিল্পে নভেরা আহমেদের উত্থান সূচিত করেছিল এক নিঃসঙ্গ, প্রথাবিরোধী স্টাইলের আবির্ভাব। সমকালীন সংকট, আধুনিক মানুষের মর্মযাতনা ফুটিয়ে তুলতে পারঙ্গম এই শিল্পীকে নিয়ে নানা গুণীজন নানা সময়ে লিখেছেন। এই লেখাগুলিরই স্থান হয়েছে ‘নভেরা আহমেদ’ শীর্ষক বইটিতে।
মোট ১৭ টি লেখা স্থান পেয়েছে এখানে। লালা রুখ সেলিম লিখেছেন নভেরার শিল্পকর্মের নানা খুটিনাটি বিষয় নিয়ে, মেহবুব সেলিম লিখেছেন নভেরার জীবনবৃত্তান্ত ও সেই সাথে তাঁর কর্মজীবনের আদ্যোপান্ত, ইকতিয়ার চৌধুরীর বর্ণনায় ফুটে উঠেছে শিল্পী নভেরার সাথে তাঁর কথোপকথন, রবিউল হুসাইন নভেরার কাজগুলি নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আয়োজিত ১৯৯৮-এর প্রদর্শনীর কথা লিখেছেন, লিখেছেন নভেরার ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। রেজাউল করিম সুমনের বর্ণনায় এসেছে ১৯৬০ থেকে সত্তরের দশকব্যাপী কর্মজীবন ও সৃষ্টি, আহমেদ সজীব লিখেছেন নভেরার জীবনবৃত্তান্ত, ময়নুল ইসলাম পল আলোচনা করেছেন নভেরার ভাস্কর্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে, আছে ‘রনবী’ খ্যাত শিল্পী রফিকুন নবীর লেখা একটি বিশদ আলোচনা, যেটি সমৃদ্ধ হয়েছে কিঞ্চিত স্মৃতিচারণে, মইনুদ্দীন খালেদ ও ইমতিয়ার শামীম লিখেছেন নভেরা আহমেদের আধুনিক শিল্পকর্মের মূল্য ও তাৎপর্য নিয়ে। তৎকালীন ঢাকা আর্টস ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিনের সংক্ষিপ্ত একটি লেখা গ্রন্থটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। সবগ লেখার সংকলনটি নির্দেশ করে এক আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পীর প্রতি, যিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন স্বদেশের শিল্পাঙ্গনের এই শাখাটিকে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক, আরো বহুল চর্চিত করবার লক্ষ্যে। যিনি আমাদের শহরগুলির নির্মাণকাজে চেয়েছিলেন ভাস্করদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, যাতে শিল্পের নৈকট্য আমাদের মন ও মননকে করতে পারে সমৃদ্ধ। এছাড়া সাদাকালো ও রঙিন অনেক আলোকচিত্র পাঠককে পরিচিত করিয়ে দেবে এক নিভৃতচারী শিল্পীর সাথে, যিনি স্বেচ্ছানির্বাসনে থেকে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালেই চলে গিয়েছেন বিদেশের মাটিতে (প্যারিসে), ২০১৫ সালে। ব্যক্তি নভেরার পাশাপাশি তাঁর সৃষ্টিও তুলে ধরা হয়েছে এই আলোকচিত্রগুলিতে, ফলে পাঠকের পক্ষে নভেরা আহমেদ ও তাঁর দর্শনকে বুঝতে সুবিধা হবে।বস্তুত ১৯৬৮ সাল থেকে দেশছাড়া নভেরা আহমেদের সৃষ্টি ও দর্শন যে আমাদের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় এবং প্রায় দীর্ঘ তিন দশকব্যাপী নিষ্ক্রিয়তা যে আমাদের জন্য কতটা অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে এনেছে তা বুঝতে হলে প্রায় আড়াই শতাধিক পৃষ্ঠার বইটি অবশ্যপাঠ্য।