বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক ও লোকচিত্র
‘বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক ও লোকচিত্র।’ বইটি তরুণ গবেষক মামুন অর রশীদের একটি গবেষণা। এই বইয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত প্রচুর বিষয়সংশ্লিষ্ট ছবি ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রতিটি লোকশিল্পের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে, দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস অন্বেষণে দেশটির ঐতিহ্যিক-চিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। বাংলাদেশের শিল্পকলা নিয়ে আলোচনায় শিকড়ের খোঁজ করা একটি জরুরি প্রসঙ্গ। শিল্পচর্চায় ইয়োরোপীয় ধ্যান-ধারণাই আমাদের শিল্পচেতনার মানদণ্ড তৈরি করে দিয়েছে।কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পকলা বলে নিজস্ব শিল্প-উপাদান রয়েছে এবং এই উপাদানমথিত শিল্পতত্ত্ব থাকা দরকার এই দাবি করছে এই বইটি। যারা জীবনের অনিবার্য অংশ হিসেবে শিল্পকে আত্মলগ্ন করেছেন তাদের কিছু শিল্প-নমুনা এই বইতে উপস্থাপিত হয়েছে। উৎসব বা অর্চনার অংশ হিসেবে যে শিল্প চর্চা হয়েছে তা-ও এখানে দেখানো হয়েছে। ইংরেজিতে যাকে রিচুয়াল অ্যান্ড ট্র্যাডিশনাল আর্ট বলা হয়, তেমন শিল্পের নমুনাও হাজির করা হয়েছে। বইয়ের প্রায় সব অধ্যায়ই ক্ষেত্র-সমীক্ষানির্ভর।
বইয়েরে প্রথম অধ্যায়টিকে বলা যায় গোটা বইয়ের আলোচনার তাত্ত্বিক ভিত্তি। লোকচিত্র ও ঐতিহ্যিক চিত্রের সংজ্ঞায়ন ও পরিধি নির্দেশ করে এতে বাংলাদেশের বিবেচনায় সেসবের তাৎপর্য চিহ্নিত করা হয়েছে। পটচিত্র নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক লেখা রয়েছে কিন্তু পটগান ও চিত্রকে সমন্বিত করে এমন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আলোচনা বিরল। গাজীর পট বিষয়ে একথা আরো বেশি জোর দিয়েই বলা যায়। ধামরাইয়ের জড়ানো পটটিও দুর্লভ। পুঁথিচিত্র আলোচনাটি সমৃদ্ধ। বরেন্দ্র জাদুঘরে ঘুমিয়ে থাকা পুঁথির বুক থেকে আলোকচিত্রের মাধ্যমে যেন প্রজ্ঞাপারমিতাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে আমাদের উজ্জীবিত করার জন্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত পদ্মাপুরাণ পুঁথিটি আশ্চর্যজনক সুন্দর। ইস্কান্দারনামা ও শাহনামা পুঁথিচিত্রের আলোচনাটি তথ্যবহুল। বাংলাদেশের চিত্রকলার ধারাবাহিকতায় এই পুঁথি দুটি ব্যতিক্রমী বাঁক সৃষ্টি করেছে। মহাভারতের বড় পাটাচিত্রের ছবি ও আলোচনার অংশটিও বাংলাদেশের চিত্রকলার জন্য অভিনব সংযোজন। শরীয়তপুর থেকে পাওয়া এই চিত্র এদেশে পাটাচিত্রের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে নির্দেশ করে। লক্ষ্মীর সরাচিত্রের আলোচনাটি পূর্ণাঙ্গ।
ভারতীয় চিত্র ঘরানাসমূহ নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা বেশ কম। পরিসর অল্প হলেও প্রায় সব কটি ঘরানাকেই স্পর্শের চেষ্টা রয়েছে, বইয়ের ভারতীয় চিত্রঘরানাসমূহ অধ্যায়ে। ভারতীয় চিত্রকলার মূল্যবান নিদর্শনগুলো দুই মলাটে নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় ও আকর্ষণীয় কাজ। হিমালয় অঞ্চলে অনুশীলিত চিত্রকলা ও চর্যাপদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির প্রয়াস অবশ্যই মৌলিক গবেষণার নিদর্শন, যা গ্রন্থটিকে উৎকর্ষমণ্ডিত করেছে।
গুরুসদয় দত্ত, দীনেশচন্দ্র সেন ও তোফায়েল আহমেদ বাংলা অঞ্চলের লোকচিত্র ও লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রবাদপুরুষ। একটি প্রবন্ধে তাদের স্মরণ করে, প্রকারান্তরে বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় তাদের পরিশ্রমের কাজ ব্যবহারের প্রতি ঋণস্বীকার করেছেন গবেষক। পূর্বসূরিদের কীর্তির প্রতি এই অর্ঘ্য আসলেই প্রসংশার দাবী রাখে।
এই বইয়ে আরো একটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ দুটি অসাধারণ গান। গান দুটোই পরিবেশনরীতির অংশ।
সব শেষে বলা যায়, কিছু গৌণ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সব মিলিয়ে বইটিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক ও লোকচিত্রের একটি প্রামাণ্য রূপ বলা যায়।