বাংলাদেশের পার্বণের রান্না
প্রস্তর যুগে আগুন আবিষ্কারের পর থেকে রন্ধনপ্রক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছে। সেই থেকে মানুষের রসনাবিলাসের জন্য যুগ যুগ ধরে এই প্রক্রিয়ায় এসেছে নানা আবর্তন ও বিবর্তন। সনাতনীভাবে এই প্রক্রিয়ার প্রধান কলালকুশলী হচ্ছেন নারীগোষ্ঠী। যুগ যুগ ধরে রান্না কর্মটি এক নারীর কাছ হতে অন্য নারীর কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। প্রতিটি হস্ত বদলের পরই এই কর্মের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে এবং রসনাবিলাসে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। তাছাড়া, সময়ের পরিবর্তনেও এই কর্মটির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। তাই রান্না একটি চলমান প্রক্রিয়া।
রান্না আজ কেবল নারীর রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে আজ যুক্ত হয়েছে একটি অর্থকরী মাত্রা এবং পরিণত হয়েছে একটি ব্যবসায়ে। তবে বাণিজ্যক্ষেত্রে নারী তার এই সনাতনী কর্মটি আর তার নিজের হাতে ধরে রাখতে পারেননি। অনেকক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে, নারী যেন ইচ্ছে করেই পুরুষের হাতে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন এই কর্মকা-টি। কারণ, তারা মনে করছেন নারীর ক্ষমতায়ন, যা অর্জন করার জন্য আজ সারা পৃথিবীর নারীগোষ্ঠী লড়াই করে চলেছেন, তা বহুলাংশে নির্ভর করছে তাদের সনাতনী কাজগুলি হতে মুক্তি পাওয়ার ওপর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, রান্না কর্মকা- ও রান্নাঘর নারীর ক্ষমতায়নের একটি শক্তিশালী উৎস। রান্নার ওপর পরিবারের সদস্যদের মনের আনন্দ ও সন্তুষ্টিই কেবল নির্ভর করে না, নির্ভর করে তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও। পরিবার নিয়ে যেহেতু সমাজ গঠিত হয় এবং সমাজ নিয়ে যেহেতু একটি দেশ গঠিত, সেহেতু পুরো দেশের জনগণের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করছে রন্ধন কর্মকাণ্ডেরর ওপর।
এই সত্য থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে, রান্না ও রান্নাঘর একজন নারীর কত শক্তিশালী ক্ষমতার উৎস। এই উৎস থেকে নারী যে কেবল সামাজিক ক্ষমতাই অর্জন করতে পারেন তা নয়, এই উৎস থেকে তিনি অর্থনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করতে পারেন।
যেহেতু এই কর্মযজ্ঞ আজ পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মোট বাণিজ্যের এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে, তাই নারীগোষ্ঠীকে সচেষ্ট থাকতে হবে যাতে তিনি তার এই সনাতনী একচেটিয়া কর্মটিকে তার পূর্ণ আয়ত্বে রাখতে পারেন এবং এর বাণিজ্যিকীকরণের পূর্ণ ফল ভোগ করতে পারেন। লক্ষ করা গেছে, রন্ধনপ্রক্রিয়া যত আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে এবং স্বল্প সময়সাপেক্ষ হয়েছে, ততই গৃহের পুরুষ সদস্যরা গৃহের রন্ধনকাজে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নারীগোষ্ঠীর সচেষ্ট হতে হবে যাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গৃহের রন্ধনকর্মটিকে স্বল্প শ্রমসাধ্য করা যায় এবং একই সঙ্গে এই কর্মের পরিবেশ রাঁধুনীবান্ধব করা যায়।
প্রতিটি দেশের রন্ধনপ্রক্রিয়ার একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকে যার সৃষ্টি হয়েছে প্রতিটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্যই প্রতিটি দেশের মানুষ তার নিজের দেশের খাবার সবচাইতে বেশি পছন্দ করে। একটি দেশের বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণকে কেন্দ্র করেও এই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সূত্রপাত হয়েছে। কথায় বলে, বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ এই বাংলাদেশ। কারণ, বাঙালিরা খুব আনন্দপ্রিয় ও উৎসবপ্রিয় জাতি।
তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ উৎসব ও পার্বণই ঋতুভিত্তিক। প্রতি ঋতুতে বাংলাদেশে শাকসবজি ও মাছ উৎপাদনে থাকে বৈচিত্র্য। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উৎসব ও পার্বণ ধর্মভিত্তিক। অবশ্য বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন একটি পীঠস্থান হয়ে উঠছে যে, ধর্মীয় পার্বণগুলিও আপামর জনগণের অংশগ্রহণে সর্বধর্মীয় হয়ে উঠেছে। এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঋতুভিত্তিক।
কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এদেশের উৎসব ও পার্বণের বৈচিত্র্যপূর্ণ সনাতনী রান্নাগুলি আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের নারী আজ ঘরকন্না কাজের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে অর্থকরী কাজেও যোগ দিয়েছেন। ফলে তার সময় নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। উৎসব পার্বণের বেশিরভাগ খাবারের রন্ধনপ্রণালি খুব সময়ঘন যা করার জন্য আজকের কর্মজীবী নারীদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে না। ফলে গৃহ-রন্ধনকৌশলগুলি স্থানান্তরিত হতে পারছে না প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আজ নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেট থেকে আহরণ করে অনেক রন্ধনজ্ঞান। কিন্তু মা, দিদিমা, ঠাকুমা, মাসি, পিসি, খুড়ি, জেঠির যুগ যুগের রন্ধন অভিজ্ঞতা, তাদের রন্ধন উদ্ভাবন এবং তাদের নিজস্ব রন্ধনকৌশলগুলি ইন্টারনেটের কোথাও স্থান পায় না। এই রন্ধনকৌশলগুলি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
এদেশের মা-দিদিমাদের বলতে শোনা যায় ‘খাদ্যের দুটি কাজ। এক, স্বাস্থ্যকে সুস্থ রেখে শরীরকে ঠিক পথে চালিত করা; দুই, রসনাকে তৃপ্ত করে মনকে আনন্দ দেওয়া।’ শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য খাদ্যের পুষ্টি গুণাগুণ জরুরি আর মনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য জরুরি হচ্ছে খাদ্যের স্বাদ, বাহার, বৈচিত্র্য এবং ঘ্রাণ। মনকে যথেষ্টভাবে আনন্দ না দিতে পারলে খাদ্য যত পুষ্টিকরই হোক, তা স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে পারে না। ফলে, খাদ্য তার দুটি কাজ করতেই অসমর্থ হয়। খাদ্যের ঘ্রাণ এত জরুরি যে, এদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং’। অর্থাৎ, খাদ্যের গন্ধেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। তাই এদেশের মা-দিদিমারা বলেন, ‘রন্ধনে রাঁধুনির মনোযোগ আর নিবিষ্টতা অতি জরুরি বিষয়। রান্না কর্মটিকে ভালোবাসতে হবে এবং তাহলেই রান্না হবে সুস্বাদু।’ বাংলাদেশের পার্বণের রান্নাতেই কেবল বৈচিত্র্য নেই, বৈচিত্র্য আছে খাবার পরিবেশনায়ও। এই বৈচিত্র্যময় পরিবেশনার চিত্রটিও তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে বর্তমান বইটিতে।