
বার্ট কোমেনের ডান হাত ও অন্যান্য কল্পকাহিনি
দীপেন ভট্টাচার্য নিশ্চিতভাবেই বিজ্ঞানের লোক। রাশিয়া-আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষ করে এখন আমেরিকারই এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। যুক্ত আছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গেও। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখালেখির বাইরে লেখেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও। সে বাবদ তার বেশ কিছু বই-ও আছে। তবে ‘বার্ট কোমেনের ডান হাত ও অন্যান্য কল্পকাহিনি’র গল্পগুলোকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির ছাদের নিচে বসিয়ে দেওয়া হলে, তা গল্পগুলোর প্রতি অবিচারই করা হবে।
গল্পগুলো ঠিক প্রচলিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো নয়, সে ধারার ফর্মুলা মেনে চলেনি সর্বতোভাবে। বরং এগুলো সাধারণ গল্পের মতোই, দৈনন্দিন জীবনের গল্প। তাতে উঠে এসেছে সাধারণ জীবনের নিত্যদিনের বাস্তবতা। গল্পগুলোতে সেই দৈনন্দিন বাস্তবতা ফুঁড়ে আচমকা মাথাচাড়া দিয়েছে চমকপ্রদ কোনো ঘটনা। তবে তাঁর এই গল্পগুলোর যে জগৎ, যে জগতে এই দৈনন্দিনতা ও সে দৈনন্দিনতার মধ্যে আচমকা কোনো চমকপ্রদ ঘটনার সংঘটন ঘটে, সেই জগৎটা আবার পরিচিত সাধারণ জগৎ নয়। সে এক রহস্যময় জগৎ। সে রহস্যময় জগতের রহস্যের সমাধান করতে কখনো সাহায্য নিতে হয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের, কখনো সাহায্য নিতে হয় মনোজাগতিক বিশ্লেষণের। আর এই কারণেই গল্পগুলোকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বলে মনে হয়, বা এগুলোকে এক ধরনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বলে মানতে হয়।
বইটির অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলোর বিশিষ্টতা কেবল এই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিময়তাতেই নয়। গল্পগুলোর আখ্যানের সময়-কাঠামো এবং সে সময়-কাঠামোর অন্তর্নিহিত বোধ বা তাৎপর্যও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই যেমন প্রথম গল্প ‘বার্ট কোমেনের ডান হাত’ শুরু করার পরপরই দীপেন ভট্টাচার্য পাঠককে এক টানে নিয়ে যান দশ বছর পেছনে। তারপর ফের দুই বছর সামনে আনেন বটে, কিন্তু দশ বছর সামনের বর্তমানে আর ফেরত আনেন না। গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোর এ-রকম সময়-কাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে লেখক সমকালীন দ্বান্দ্বিকতার যেমন উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, তেমনি গল্পগুলোর বাস্তবতাকে রহস্যময় করে তুলে সেগুলোতে এক ধরনের পরাবাস্তবতার আস্বাদও এনেছেন। সবমিলিয়ে পাঠকের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েছেন এক বিনীত আহ্বান, গল্পগুলোর সময়-কাঠামোর প্রকৃতি বুঝে নেয়ার।
‘বার্ট কোমেনের ডান হাত’ ছাড়াও গল্পগ্রন্থটিতে আছে আরো সাতটি গল্প Ñ ‘প্রজাপতির স্বপ্ন’, ‘মাউন্ট শাস্তা’, ‘কাপ্রির নীল আকাশ’, ‘প্রতিসরিত প্রতিবিম্ব’, ‘তৃতীয়া’, ‘নিয়ন বাতি’ এবং ‘নিওলিথ স্বপ্ন’। এই আটটি গল্পের মধ্যে পাঁচটিই তিনি এক নিশ্বাসে বলেননি, মাঝে মাঝে বিরতি নিয়েছেন। প্রথম তিনটি গল্প কতগুলো উপশিরোনামে বিভক্ত করেছেন। সেগুলোর মাধ্যমে অনেকগুলো ভাগে বিন্যস্ত করে, কয়েক দফায় পুরো গল্পটা বলেছেন। শেষ দুটো গল্প বিবৃত করেছেন কয়েকটা ভাগে ভাগ করে। অবশ্য মাঝের আর তিনটা গল্প বর্ণনা করেছেন এক নিশ্বাসেই।
এই সব গল্প নিয়ে দীপেন ভট্টাচার্য সত্যিই একটা রহস্যময় জগৎ নির্মাণ করেছেন। তবে সে জগৎ আবার দৈনন্দিন জীবনের বেশ ঘনিষ্ঠ। তাই লেখক বইয়ের শুরুতে যখন ঘোষণা দিয়েছেন, বইটির প্রতিটি কাহিনির প্লট ও চরিত্রসমূহ নিতান্তই কাল্পনিক, সে ঘোষণাতেও একটা ফাঁক রেখে দিয়েছেন। লিখে দিয়েছেন, যদি কোনো পাঠকের মনে হয় ‘তিনি কোনো গল্পের সাক্ষী’, তবে যেন যোগাযোগ করেন। সেই যোগাযোগের জন্য মেইল অ্যাড্রেস আবার সেখানে দেননি, সেটা আবার খুঁজে নিতে হবে গল্পগুলোর মধ্যে থেকে। মানে এই ব্যাপারটিকেও গল্পগুলোর সাথে মিশিয়ে, সেই রহস্যময় জগতের একটা অংশ করে নিয়েছেন। যে জগতের বাস্তবতার স্বরূপের কারণে লেখক গল্পগুলোকে কেবল ‘কল্পকাহিনি’ বলেছেন, যদিও সেগুলোর মধ্যে ‘বিজ্ঞান’ও আছে সুনিশ্চিতভাবেই।