
বালিকার চন্দ্রযান ও অন্যান্য
‘বালিকার চন্দ্রযান ও অন্যান্য’। বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের পাঁচটি উপন্যাসের সংকলন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পঞ্চাশের দশক থেকে যে কজন হাতেগোনা সৃজনশীল মানুষ এদেশের সাহিত্যকে সাবালক করে তুলছেন এবং মধ্যবিত্ত গণ্ডিবহির্ভূত বৃহত্তর মানুষের জীবনযুদ্ধ নিয়ে এক মহান মানবিকতার সৌধ রচনা করছেন সৈয়দ হক তাঁদের অন্যতম। ভাষা ও শৈলীর দিক থেকে নিশ্চিতই এক লক্ষ্যে উপনীত হয়েছেন। এই কৃতী লেখক বিভাগোত্তর সাহিত্যকে যেভাবে পালটে দিয়েছেন, আর কোনো একক লেখকের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গান, চলচ্চিত্রের কাহিনীসহ একা হাতে সৈয়দ হককে অনেককিছুই রচনা করতে হয়েছে। সব্যসাচী উপাধিটা চিরদিনের জন্য এভাবেই যুক্ত হয়ে যায় তাঁর নামের সঙ্গে।
দেশভাগের পর ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক একটি মাইলফলক। যিনি ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যকে গ্রামনির্ভরতা থেকে প্রথম নাগরিকমনস্কতায় তুলে ধরেন। পঞ্চাশের দশকে, তখনো ঢাকায় নগরায়ণ, আধুনিক নাগরিকতার ছোঁয়া লাগেনি। অভিযোগ উঠেছিল অশ্লীলতার। একই সঙ্গে নিন্দিত এবং অভিনন্দিত হয়েছেন তিনি।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার সীমানা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে উজ্জ্বল, অমলিন, চিরায়ত উচ্চতায়।
তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে রয়েছে প্রকরণ পরিচর্যা, শ্রমনিষ্ঠার স্বাক্ষর। ভাষার সৌকর্য ও কারুকার্য পাঠককে বিস্মিত করে। ঘনপিনদ্ধ এক ভাষাভঙ্গি ছিল তাঁর আয়ত্ত। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনার প্রচেষ্টা বিদ্যমান।
‘বালিকার চন্দ্রযান,’ ‘অন্য এক আলিঙ্গন,’ ‘মৃগয়ায় কালক্ষেপ’, ‘দুধের গেলাশে নীল মাছি’ ও ‘তুমি সেই তরবারি’ এই পাঁচটি উপন্যাস লন্ডনের পটভূমিতে বাঙালিদের গল্প। পাশ্চাত্য সমাজ-সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া বাঙালিদের শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা, উল্লম্ফন, বাস্তবতা ও অস্তিত্বের যন্ত্রণা, তৃষ্ণার্ত প্রেমের আত্মলীন, অনুতাপ, আর্তি, বিবমিষা প্রধান হয়ে উঠেছে ওই উপন্যাসগুলিতে। যেমন ‘তুমি সেই তরবারি’ উপন্যাসে এক তরুণ দম্পতি এক বন্ধু দম্পতির বাসায় সাবলেট থাকে। তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর বন্ধুর পরকীয়া গড়ে ওঠে। অচেনা গল্প নয়, তবু প্রকাশের সৌকর্যে সেটি অভিনব হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক বিষয়ের সঙ্গে কাল্পনিক প্রেমকথা বুনে দিয়েছেন সৈয়দ হক তাঁর ‘দুধের গেলাশে নীল মাছি’ উপন্যাসে। ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্তে ব্যক্তি মাহতাব অনন্য হয়ে উঠেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু কালের গণ্ডি অতিক্রম করে সর্বকালীন হয়ে উঠেছেন।
বড় নিপুণ কৌশলে, জাদুকরের মতো তিনি ঘটনার বিন্যাস করেন উপন্যাসে। চেনা মানুষ, চেনা গল্প আর চেনা থাকে না, গভীর বিস্ময়ে এবং আমাদের ভেতরটি ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলে – সত্য! এরকমই হয়। সুখের আড়ালে মুখোশ, শঠতা, ভণ্ডামির পলেস্তারা খসে গিয়ে ভেতরের মানুষটিকে উন্মোচিত করেন সৈয়দ হক তাঁর উপন্যাসে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পর বাংলাদেশের সাহিত্যে উপন্যাসের ভাষা, আঙ্গিক, প্রকরণ নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ছাড়া এত নিরীক্ষা আর কেউ করেননি।