
মাল্যবান: মূলানুগ পাঠ
মাল্যবান: মূলানুগ পাঠ। বেঙ্গল সংস্করণে এই উপন্যাসটি মূল পাণ্ডুলিপি অনুসারে সম্পাদনা করেছেন ভূমেন্দ্র গুহ। এবং বইটির শেষে প্রায় অর্ধেক বইজুড়ে উপন্যাসে উল্লিখত প্রসঙ্গগুলোকে বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। যার কারণে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে ভিন্নমাত্রাসঞ্চারী।বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী রফিকুন নবী।
অনেক মনে করেন ‘মাল্যবান’ জীবনানন্দ দাশের লেখা প্রথম উপন্যাস, কথা সত্য নয়। এটা হয়তো প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। এই উপন্যাসের রচনাকাল ১৯৪৮ সালে। এটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৭০ সালে।
‘মাল্যবান’ উপন্যাস একটি দাম্পত্য জীবনের আখ্যান। এখানে প্রকৃত অর্থেই জীবনানন্দ আধুনিক হতে পেরেছেন। ব্যক্তি মানুষের অসহায়ত্ব, জীবন নিয়ে খেলা, আপস করার কৌশলকে দেখে তা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। তাঁর চেষ্টার প্রতিনিধিত্ব করে তাঁর রচিত ’মাল্যবান’ চরিত্রটি। আড়াইশো টাকা মাইনে পাওয়া মাল্যবানের আর্থিক সামর্থ্য কম; কিন্তু মাল্যবান তার স্ত্রী উৎপলা ও সন্তান মনুকে সুখে রাখতে চায়। কিন্তু আধুনিকা উৎপলা চায় জৌলুস। তাই মাল্যবান ছিটকে পড়ে। উৎপলা বাড়ির ওপরের ঘরে ভালো কক্ষে আরামে থাকে। সেখানে মাল্যবানের স্থান হয় না। মাল্যবানকে জীবন কাটাতে হয় বাড়ির নিচের তলার কক্ষে ইঁদুরের সঙ্গে। উৎপলার কাছে আনন্দ করা, পার্টি করা, সিনেমা দেখা, পার্কে ঘুরে বেড়ানোই জীবনের নাম। দামি শাড়ি পরার মধ্যেই সে শান্তি পেতে চায়। মাল্যবান উৎপলার এ দাবি মেটাতে পারে না। এক সময় উৎপলা মাল্যবানের সামনেই গ্রহণ করে সমরেশকে। নিত্য অভাবে রোগাক্রান্ত কল্যাণী হেমের সঙ্গে সুখী নয়। তবু সে আপস করেছে ভাগ্যের সঙ্গে, জীবনকে বয়ে বেড়িয়েছে। পরবর্তী সময়ে মাল্যবান উপন্যাসে জীবনানন্দ যেন সে দায় এড়াতে চাইছেন। যেন কল্যাণীর যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করেই উৎপলা-সমরেশ আখ্যানের সূচনা।
জীবনানন্দের উপন্যাসে সংঘাত আছে, আছে গভীর জীবনবোধ। এ সংঘাত সমাজের সঙ্গে নয়, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নিজের অস্তিত্বের। তাই মাল্যবান, উৎপলা, হেম, কল্যাণী সবার বেদনাই আলাদা, অস্তিত্বের যন্ত্রণাও আলাদা। তারা পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছে। জীবনকে, দাম্পত্য জীবনকে তিনি এক উৎকট রূপে প্রত্যক্ষ করেছেন। কখনো মনে হয়েছে হয়তো প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিজীবন এমনই আবার পরক্ষণেই এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। যে সংকট নিজে অনুভব করেছেন সেটা এতটা খোলামেলা প্রকাশ হোক তা হয়তো চাননি জীবনানন্দ দাশ। এখানে জীবনের গভীরতা আছে। আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের সংকট আছে।
পরিশেষে বলা যায়, যেহেতু ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের এই সংস্করণটি মূল পাণ্ডুলিপি অনুসারে মূলানুগ পাঠের মধ্য দিয়ে গ্রন্থিত হয়েছে সেহেতু এটিকে আমরা সর্বশেষ নির্ভুল গ্রন্থ বলতে পারি।