
সবচেয়ে সুন্দর করুণ
১৯৭১। ১৯৯০। ২০১৩। মুক্তিযুদ্ধ। স্বৈরাচারের পতন। রাজাকারদের বিচার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের তিনটি মাইলফলক। এই তিনটি ঘটনাই বাংলাদেশের ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আছে। এই তিন সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেছে, যাত্রা করেছে সদর্থকতার পথে। অবশ্য তার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। প্রতিরোধ করতে হয়েছে প্রচ- বিরুদ্ধ শক্তির। সবচেয়ে বড় সংগ্রাম ছিল প্রথমটা – মুক্তিযুদ্ধ। সেটা বাংলার মানুষের মহত্তম মহাকাব্য। তখন সারা বাংলার মানুষ যুদ্ধে নেমেছিল। লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধে গিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল। সে যুদ্ধে যারা বাংলার মানুষের বিরুদ্ধাচারণ করেছিল, মাঝে স্বৈরাচাররা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে, তাদেরই বসাল গদিতে। স্বৈরশাসনের পতন ঘটল ১৯৯০-এ, সেও এক উত্তেজনাপূর্ণ সময়। আর ২০১৩ সাল গণজাগরণের বছর। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সে বছর উত্তাল হয়ে উঠেছিল শাহবাগ। তার বিরুদ্ধেও অবশ্য গজিয়ে তোলা হয় বিরোধী শক্তি, রাজনৈতিক ‘নাস্তিকতা’ টার্ম আমদানি করে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর ‘সবচেয়ে সুন্দর করুণ’ উপন্যাসে বাংলাদেশের ইতিহাসের এই তিন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে একটি কাহিনিতে আত্মীকৃত করেছেন। ইতিহাসের এই তিন টার্নিং পয়েন্টকে স্থান করে দিয়েও উপন্যাসটি ঠিক রাজনৈতিক উপন্যাস হয়ে ওঠেনি। বরং এটি একজন সাধারণ মানুষের জীবনকাহিনি; যার নাম সুমন, যে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, যার মা তাকে বহু সংগ্রামে মানুষ করেছেন, যে একজন নিপাট ভদ্রলোক, খুব সাধারণ একটি জীবনযাপন করেন। সুমনের একজন অত্যন্ত ভালোমানুষ স্ত্রী আছেন – সোমা। তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর প্রতি তার প্রেম ছিল, সেই প্রেমও আছে এখনো। তার সেই বান্ধবী, দীপা, স্বামীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, সেও তাকে এখনো পছন্দ করে। তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগও হয়। কিন্তু তারা তাদের সে সম্পর্ককে কলুষিত করে না। বরং তাদের দুজনের পরিবারের আর সব সদস্য, এবং তাদের বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে তারা তাদের জগৎটাকে নিয়ত সুন্দর করার সংগ্রাম করে চলেছে।
প্যারালালে বিবৃত হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্প। সুমনের বাবা-মামা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সুমন-দীপারা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, তখন দেশ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। সুমন খানিকটা নিষ্ক্রিয় হলেও, তার বন্ধুরা সে আন্দোলনে ভীষণ সক্রিয় ছিল। এর বছর দুয়েক পরে যখন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালদের বিচারে গণআদালত বসল, তাতে বন্ধুদের সাথে সক্রিয় হয়ে উঠল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সুমনও। এসব পুরনো গল্প। যে সময়কাল উপন্যাসটির বর্তমান, সে বর্তমানের পথপরিক্রমায় শাহবাগ উত্তাল হয়ে ওঠে, রাজাকারদের বিচারের দাবিতে। উত্তাল শাহবাগ প্রভাব ফেলে সুমন-দীপাদের জীবনেও। তারপর আসে অ্যান্টি-শাহবাগ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা – নাস্তিকতার টার্ম। শাহবাগে যাওয়ার কারণে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে, সুমনকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে দেয়া হয়।
এভাবে উপন্যাসটির মূল কাহিনির প্যারালালে এগিয়ে যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি বয়ান। মূল কাহিনিটি পরিণতির দিকে এগোতে থাকলেও রাজনৈতিক বাস্তবতার বয়ানটি কোনো পরিণতির দিকে এগোয় না। কারণ বাস্তবেও বাংলাদেশের রাজনীতি কোনো নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে এগোচ্ছে না। তবে ২০১৩-এর শাহবাগ যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকবে, তা নিশ্চিত করে উচ্চারণ করেন ঔপন্যাসিক। তবে সে পরিবর্তনটা ইতিবাচক হবে কিনা, সে সম্পর্কে তিনি অতটাও নিশ্চিত নন। তবে তিনি নৈরাশ্যবাদীও নন, দেশ ছাড়ার ভাবনা তাকে তাড়িত করে না। তার কাছে বাংলাদেশ সেই জায়গা, যার সম্পর্কে জীবনানন্দ বলেছেন – ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ’। সেই ‘সবচেয়ে সুন্দর করুণ’ দেশটাকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। তাই সুমনের মুখ দিয়ে তিনি নিজের আকাক্সক্ষাই উচ্চারণ করেন উপন্যাসের একদম শেষ বাক্যে- ‘এই সবচেয়ে সুন্দর করুণ দেশটি ছেড়ে আমি কোথাও যাব না’।