
সুখবাস
জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের চতুর্থ ছোট উপন্যাস ‘সুখবাস’। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগে তাঁর আরো তিনটি ছোট উপন্যাস, যথাক্রমে শূন্য নভে ভ্রমি, অমল তরণী তার এবং স্বপ্নের সীমানায় পারাপার ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। ‘সুখবাসে’র নিবেদন অংশে লেখক লিখেছেন, ‘ইংরেজিতে ‘নভেলা’ (ঘড়াবষষধ) কিংবা ‘নভেলেট’ বলা হয় এরকম রচনাকে ‘উপন্যাসিকা’ বলে বাংলায়। পরিপূর্ণ উপন্যাস নয়, আকারে ছোট, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসরমান, যথেষ্ট বিস্তৃত জীবনজমিনের ওপরে তাকে বসানো চলে। শিল্পের নানা প্রকরণ কি ভাষার ব্যবহারে নতুন চিন্তা সেখানে যথেষ্ট প্রয়োজনীয় নয়।’
আলোচ্য গ্রন্থে আটটি পরিচ্ছেদ আছে, কিন্তু প্রচলিত উপন্যাসকাঠামোর ধারাবাহিক কাহিনিবিন্যাস তাতে নেই। ভিন্ন ভিন্ন নামে উপস্থাপিত এসব পরিচ্ছেদে লেখকের জীবনকালের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের বাস্তব ও প্রতীকী বর্ণনার মধ্যে উপরিকাঠামোর পরম্পরা তেমন খুঁজে পাওয়া না গেলেও অন্তর্গত বোধের নিরবচ্ছিন্নতা অবশ্যই অনুভব করা যায়।
প্রথম পরিচ্ছেদ ‘সব ভোরে পাখি ডাকে না’য় লেখক প্রথমেই বলেন এই বইয়ের যে মূল চরিত্র তার বিদেশ গমনের কথা। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রা, সেখানে মূল ছিঁড়ে আসার কষ্ট যেমন ছিল, তেমনি ছিল কিছু উত্তেজনাও। মনের মধ্যে ছিল স্বপ্ন ও আদর্শ। ‘কৈশোর ও যৌবনের সমাজকল্যাণ চিন্তা মনে প্রবল ছিল। আহরিত জ্ঞান স্বার্থসেবী হবে না এই বোধ তীব্র ছিল। তাই সে ভেবেছিল ফিরবে একদিন।’ তারপর কর্মস্থলে, টেলিপ্রিন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সে পঁচিশে মার্চের সাক্ষী হয়েছিল। বহির্বিশ্বের প্রথম কয়েকজনের মধ্যে। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের বিচরণ বহু টুকরো হয়ে সামনে আসে।… খবরের টুকরো আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বভূমির পরিচিত সব জনকে জানাতে থাকে। সান্ধ্য বৈঠকের পরে দূর শহরে, আরো দূর শহরে সমমনাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। মিছিল, প্রচার, অর্থ সংগ্রহ ইত্যাকার কর্মসূচিতে সাফল্যের আশায় সে যখন প্রিয়জন হারানোর দুঃখ মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তখনই দেখেছিল, সঙ্গে যাদের আসার কথা ছিল তাদের সবাই আসেনি। তারা দূর থেকে দেখেছে, সরে গেছে।
‘কিন্তু কী আশ্চর্য, নতুন দেশে পূর্বে অনুপস্থিত সবাই আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটে এসে কল্পিত কৃতিত্বের পুরস্কার মাথায় তুলে নিয়েছিল। সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ মেলে না তার চায়ওনি সে কিছু।’
উদ্ধৃতি একটু দীর্ঘ, কিন্তু এ-বইয়ের ‘সে’ নামক মানুষটির পরিচয় উদ্ঘাটনে এরও বোধহয় প্রয়োজন ছিল। কারণ আমরা এই মূল চরিত্রটির কাঠামোবদ্ধ পরিচয় কোথাও একসঙ্গে পাই না। সে-পরিচয় আমাদের কাছে পৌঁছায় পরিচ্ছেদগুলোর ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপনের মাধ্যমে। লেখক তো প্রথম পরিচ্ছেদেই আমাদের জানিয়ে দেন Ñ ‘সে কখনো অন্যায়ী নয় অথচ অন্যায়ের প্রতিবাদে চিরকাল সোচ্চার, এমন কথা বলতে পারে না। সে মিথ্যাবাদী নয় কিন্তু সত্যের খাতিরে জীবন বিসর্জন দেওয়ার মতো প্রতিজ্ঞাও নেই।…’
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ‘ভিন্ন দৃশ্য, ভিন্ন দিন’-এ আমরা সেই মানুষটিকে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে দেখি, যদিও উৎসের সঙ্গে তাঁর অচ্ছেদ্য বন্ধনের কথাও শুনি। তনয়াকে তুষারশুভ্র কন্যা আর সাত বামনের গল্প শোনাতে গিয়ে তার মনে নীলকমল-লালকমল চলে আসে এবং ‘আব্বাসউদ্দিন ক্রমাগত উইলি নেলসনের কণ্ঠরোধ করে দেন’। তবু তো সেখানেই জীবন কেটে যায়। মানুষের চাওয়া না-চাওয়ার দূরত্ব ঠিক কোথায় গিয়ে একাকার হয়ে যায়, সে-কথা বুঝতে পারা যায় না।
‘আঁধার-আলোর মাঝখানে’, ‘ছায়া দাও’, ‘যদি কেউ ফেরে’, ‘দিকচিহ্নহীন’, ‘যেন এক বাগানবাড়ি’ এবং ‘ফেরবার শেষ বাড়ি’ পরবর্তী এই ছয়টি পরিচ্ছেদেও আমরা সেই মানুষটিরই ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত ও বাস্তব জীবনযাপনের বিভিন্ন প্রসঙ্গের খোঁজ পাই এবং এর মধ্য দিয়ে একজন আত্মগত মানুষের রেখাচিত্র আমাদের কাছে উপস্থিত হয়।
সুখবাসের মধ্যে অন্তর্গত এক কাহিনি আছে। তার চেয়েও বড় কথা এটি সুখবাসের সন্ধানকামী এক মগ্নচিত্ত স্মৃতিকাতর মানুষের আত্মকথা, যেটি রচিত নিরেট বুননে নয়, ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতিময় গল্পে। সে-গল্প উচকণ্ঠ নয়, কিন্তু আত্মগত উচ্চারণে হৃদয়স্পর্শী।