
সুচের ওপর হাঁটি
একজন লেখক বা কবির জন্ম হওয়ার জন্য মানবিক উনুনে যেসব অনুভূতির জ্বালানি দরকার, তার সবই আছে একজন নারীর জীবনে। গণিতের সূত্র মেনেই বলা যায়, পুরুষের জীবনের যত প্রেম-প্রত্যাখ্যান, বিরহ, কলঙ্ক, দ্রোহ তার সকলের সমান ভাগিদার নারী। অথচ সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় তাতে নারীর প্রতিনিধিত্বের নজির প্রায় বিরল। ইউরোপীয় সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে নারীদের একটা স্বকীয় স্বর খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের জন্য সেটা ছিল গঠনের যুগ, নারীদের নিজের ভাষা খুঁজে পেতে ফিরে যেতে হবে আরো পেছনে। বলা যায়, উত্তরাধুনিক বাংলা সাহিত্যপটে ধীরে ধীরে সাহসী নারীদের আবির্ভূত হতে দেখা যায়, যাঁরা পুরুষতান্ত্রিক নান্দনিকতার বাইরে বেরিয়ে নতুন করে সৃষ্টি করেন নারী চরিত্রগুলোকে। শুরু থেকে কবিতা এবং উপন্যাসে ‘হয় বেশ্যা, নয় ফেরেশতা’ ডাইকোটোমিতে আটকে থাকা নারীদের স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে তুলে আনেন। কবি শেলী নাজ এই ব্যারাকেরই একজন শব্দযোদ্ধা।
পুরুষের যে কামনা কবিতার জন্ম দেয় তা নারীকে কখনো উপস্থাপন করে আধ্যাত্মিকতার উৎসমুখ হিসেবে, আর মনের খেয়ালে কখনো তাকে এঁকেছে নিতান্ত অর্থহীন মাংসপিণ্ড হিসেবে। এর বাইরে নারী জীবনে যে অনুভূতি এবং অভিব্যক্তির নিজস্ব আঙিনা, স্বকীয় ভাষা তার খোঁজ পাওয়া যায় শেলী নাজের কাব্যগ্রন্থ ‘সুচের ওপর হাঁটি’তে। ধর্ম, রাষ্ট্র, শিল্প, নৈতিকতাসহ পুরুষতন্ত্রের সকল কাঠামোকে ঝাঁঝালো এবং ক্ষুরধার শব্দে আক্রমণ করেছেন তিনি, করেছেন খণ্ডন। আবার একই সাথে নারীবাদিতার স্টেরিওটাইপ অতিক্রম করে লিঙ্গবিভাজনের বাইরের যত মানবিক ব্যথা-বেদনা-ক্লান্তি তাও উঠে এসেছে, পুরো কাব্যগ্রন্থকে ভারি করে রেখেছে যৌনতার গন্ধমাথা নস্টালজিয়া : ‘প্রেমিকের আঙুল ছিল পর্যটক আমার শরীরে/ কী প্রবল নেশা অথচ বারণ/ ক্ষীর জমে মন্থনের পর, চামড়ায় তীব্র শরে’। কিংবা ‘মাংসাশী’ কবিতায় : ‘মাংস বিক্রি করে কিনি প্রেম, প্রাণবায়ু মাংসাশী শহরে।’
কবি শেলী নাজের জন্ম সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায়। তবে কবির শৈশবের দিনগুলি কেটেছে সমুদ্রবিধৌত চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক হয়ে জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে সহকারী জীবাণুবিদ হিসেবে চাকরিজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ : ‘নক্ষত্র খচিত ডানায় উড্ডীন হারেমের বাঁদী’। অন্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে, ‘চর্যার অবাধ্য হরিণী’, ‘সব চাবি মিথ্যে বলে’, ‘মমি ও মাধুরী’ প্রভৃতি।