
শতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: জয়নুল আবেদিন
জয়নুল আবেদিন’ গ্রন্থে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন আবুল মনসুর। শিল্পী হিসেবে এবং শিল্পকলার সংগঠক হিসেবে এদেশে তাঁর অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান ও ভূমিকাকে পুনরায় অবলোকন কিংবা মূল্যায়নের প্রচেষ্টা এ গ্রন্থ। আধুনিক শিল্পকলার নিত্যপরিবর্তনশীল জগতে প্রায় ত্রিকাল অতিক্রান্ত জয়নুল আবেদিনকে একালের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাছে উপস্থাপনের সুদৃশ্য মানসম্পন্ন প্রয়াস চালিয়েছেন আবুল মনসুর। স্বনামখ্যাত ব্যক্তির আলোচনা, বিশেষ করে আলোচক যদি স্বগোত্রভুক্ত হন, তাহলে সম্ভ্রম ও আবেগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। তবে নির্মোহ আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েই তিনি একবিংশ শতকের নতুন বাস্তবতায় শতবর্ষের জয়নুলের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রাপ্য অবস্থানের ওপর আলোকপাত করেছেন। এই আলোচনার সূত্রে জয়নুল ও তাঁর সময়ের কিছু অনালোকিত প্রসঙ্গ উন্মোচন ও বিবেচনার অবকাশ তৈরি হয়েছে।
ছয় দশকের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলার চর্চা এখন এদেশের শহুরে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অথচ খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, একটা সময়ে এই সমাজে শিল্পচর্চা ও শিল্পীকুল ব্রাত্য হিসেবেই বিবেচিত ছিল। প্রচলিত সামাজিক মর্যাদায় ললিতকলার মানুষের খ্যাপা, উচ্ছন্নে যাওয়া প্রায় সমাজ-বহির্ভূত চরিত্র হিসেবেই দেখা হতো। শিল্পীদের ছন্নছাড়া জীবনচর্যাই শুধু নয়, সামাজিক জীবনযাপনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পেশাও ছিল এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণ। তবে সমাজ যেহেতু ক্রিয়াশীল, সমাজের বৈষয়িক ও মানসিক অগ্রগতির সঙ্গে সামাজিক প্রয়োজনের সূত্রে শিল্পীদের সম্পর্কে মানুষের অস্বচ্ছ ধারণারও পরিবর্তন ঘটেছে। নিকট অতীতের শিল্পী নামের লক্ষ্মীছাড়ারা এখন অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্মীর বরপুত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। ফলে সামাজিক কৌলিন্যে কুলীনকুলের একাসনেও তাঁদের আসন নির্ধারিত থাকছে।
বাংলাদেশে চারুকলার পথ নির্মাণের অগ্রপথিক জয়নুল আবেদিন, এ-বক্তব্য প্রায় প্রশ্নাতীত। একটি অপ্রস্তুত সমাজে বিরুদ্ধ পরিবেশে শিল্পকলার বীজ বুনেছিলেন তিনি। জয়নুল একাধারে স্বনামখ্যাত চিত্রকর, সার্থক সংগঠক। সমাজ তাঁকে শিল্পাচার্য অভিধায় ভূষিত করেছে। নানা কারণে আমাদের সংস্কৃতি-জগতে তিনি এক স্মারকতুল্য চরিত্র। যে-যুগ যে-সমাজে তাঁর আবির্ভাব, যে-কোনো বিবেচনায় তাকে ব্যতিক্রম বলা চলে। শিল্পী হওয়ার চরম স্পর্ধাকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে প্রতিষ্ঠিত করাই শুধু নয়, একটি অনালোকিত জাতির শৈল্পিক স্বপ্নযাত্রার কা-ারি হয়েছিলেন তিনি।
বাঙালির আধুনিক সংস্কৃতিতে জয়নুল আবেদিনের অবদান মানে ও মননে সুউচ্চ কৃতিত্বের দাবিদার। পরবর্তীকালে বিভক্ত বাংলায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত একটি সমাজে শিল্প-আন্দোলন গড়তে গিয়ে শিল্পের কা-ারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। চারুকলার অনিশ্চিত অভিযাত্রায় শিল্পের পথে পথ ভেঙে এগিয়ে চলার নিরন্তর সাধনায় ব্যাপৃত থাকা তাঁর পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই অহল্যা ভূমিতে শিল্পকলার যে কর্ষিত ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন তিনি, ছয় দশকের পথচলায় তা আজ পত্রপল্লবে পুষ্পিত বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলার অবিসংবাদিত অগ্রদূত জয়নুল আবেদিন। বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক জাগরণের রেনেসাঁস-মানব হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা চলে।
এই প্রজন্মের কাছে জয়নুল আবেদিনের পরিচয়, পাঠ্যপুস্তকে শিল্পাচার্য কে? কিংবা বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনের পথিকৃৎ কে? ইত্যাকার দু-একটি প্রশ্নের মাঝেই সীমাবদ্ধ। বেঙ্গল পাবলিকেশ্নস প্রকাশিত সুদৃশ্য ও উন্নতমানের এ প্রকাশনা সেই অপূর্ণতা কিছুটা পূর্ণ করতে সমর্থ হবে বলে আশা করি।