
তাঁর সৃষ্টির পথ
আনিসুজ্জামান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সমস্ত ধারাতেই তিনি হাত দিয়েছিলেন, ফুল ফুটিয়েছিলেন। বাংলায় তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞকে তুলনা করা যেতে পারে টাইটানের জীবনব্যাপী কর্মের সঙ্গে। তিনি ষাট বছরেরও বেশি সময় সাহিত্যসাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন। তাঁর রচনা কি পরিমাণে কি বৈচিত্র্যে – দুই বিবেচনাতেই বিপুল। লিখেছেন সহস্রাধিক কবিতা, প্রায় দুই ডজন নাটক-নাটিকা, আটটি উপন্যাস, আটটিরও বেশি গল্পগ্রন্থ, দুই হাজারেরও বেশি গান, যেগুলোর কথা ও সুর দুই-ই তাঁর নিজের এবং সাহিত্য-সমাজ-ধর্ম-রাজনীতিসহ বিবিধ বিষয়ে শত শত প্রবন্ধ ও গদ্যরচনা। শুধু যে বাংলা সাহিত্যের নানা অঙ্গনে তিনি ফুল ফুটিয়েছিলেন, তাই নয়। প্রতিটিতেই কোনো না কোনো ধরনের গুণগত পরিবর্তন এনেছিলেন। কোনো ধারা তাঁর হাতে পড়ে পায়ের নিচে শক্ত ভিত্তি লাভ করেছিল, আবার কোনো ধারা তাঁর হাত ধরে পৌঁছে গেছিল বৈশ্বিক মানের উৎকর্ষতায়। আর তারচেয়েও গুরুতর বিষয়, যেটা তিনি নিজেও খানিকটা স্বীকার করেছিলেন, এই বিপুল সাহিত্যসম্ভার রচনা করতে গিয়ে বাংলা ভাষাকেই তাঁর গড়ে নিতে হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মযজ্ঞ কেবল সাহিত্যক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথও নিয়ত যে বিপুল কর্মসাধনায় ব্যাপৃত রাখতেন নিজেকে, তার পরিমাণও বিপুল। তিনি সাহিত্যসাধকের বাইরে একাধারে ছিলেন শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও ধর্ম-সংস্কারক। এমনকি রাজনীতিতেও সক্রিয়তা ছিল তাঁর। অবশ্য সর্বদা তাঁর পক্ষে তাঁর ভাবনা ও বিশ্বাস অনুসারে বাস্তবে কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব হয়নি। অনেক আচার-প্রথা থেকে তিনি বের হতে পারেননি, অনেকগুলো থেকে বের হতে তাঁর অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু তাঁর মধ্যে নিরন্তর এই ভাঙা-গড়াটা ছিল, নিয়মিত নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা, পুরনো ভুলগুলো শুধরে নেয়া, নূতনের আবাহনে অবগাহন করা।
বাংলার এই অনন্য ব্যক্তিত্ব, পূজনীয় সাহিত্যিক ও অনুসরণীয় সংস্কারক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের ওপর রচিত আনিসুজ্জামানের ১১টি প্রবন্ধের সংকলন ‘তাঁর সৃষ্টির পথ’। সমসাময়িক সময়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প-িত আনিসুজ্জামান অবশ্য সবগুলোই প্রবন্ধ আকারে লেখেননি। এমনকি সব বাংলাতেও লেখেননি। ছয়টি প্রবন্ধ মূলত বক্তৃতার লিখিত রূপ, বা অভিভাষণ – ‘রবীন্দ্র-বিশ্ব’, ‘নানা রবীন্দ্রনাথের মালা’, ‘রবীন্দ্রনাথের নারীরা’, ‘তাঁর সৃষ্টির পথ’, ‘রবীন্দ্রনাথের উৎসব-ভাবনা’ এবং ‘সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ’। এর মধ্যে ‘রবীন্দ্র-বিশ্ব’র মূল বক্তৃতাটি ছিল ইংরেজিতে। বাকি পাঁচটির মধ্যেও একটি মূলত তাঁর দুটি বক্তৃতার ভিত্তিতে রচিত – ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ’। বক্তৃতা দুটো তিনি দিয়েছিলেন ২০০৭ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ২০০৮ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। আর ‘ইংরেজি গীতাঞ্জলি : রচনা ও অভ্যর্থনা’ লিখেছিলেন অ্যাডর্ন থেকে প্রকাশিত গীতাঞ্জলি-র ভূমিকা হিসেবে।