
দক্ষিণী ও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য গল্প
গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই লাতিন আমেরিকা বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বিশেষ করে লাতিন গল্প-উপন্যাস বৈশ্বিক পাঠকদের ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। ফলাফল, লাতিন-জাত জাদুবাস্তবতার মোহে পড়ে যায় তাবত বিশ্বের সব ভাষার সাহিত্যিক ও সাহিত্যানুরাগীরা। বাংলা ভাষার সাহিত্যামোদীরাও এর ব্যতিক্রম নন। তবে বাংলায় লাতিন সাহিত্যের পরিচয় করানো হয় একটু দেরিতেই, নব্বইয়ের দশকে এসে। সে পরিচিতিকরণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল ‘যাদুবাস্তবতার গাথা’ নামে একটি লাতিন আমেরিকার গল্পের সংকলন। সেই সংকলনটি সম্পাদনা করেছিলেন যিনি, সেই আলম খোরশেদ তাঁর দীর্ঘ সাহিত্যসাধনার অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত যত লাতিন গল্পের অনুবাদ করেছেন, সেগুলোরই একটা সালতামামি এই অনুবাদ গল্পগ্রন্থ- ‘দক্ষিণী ও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য গল্প’।
লাতিন আমেরিকার গল্প বিশ্বসাহিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যদিও গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, কিন্তু যাত্রা শুরু করেছে তারও প্রায় সোয়াশো বছর আগে। প্রথম লাতিন ছোটগল্পকারের স্বীকৃতি দেয়া হয় আর্হেন্তিনার এস্তেবান এচেবারিয়াকে। তবে লাতিন গল্পের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ হয় আরো অনেক পরে, এই শতকের শুরুর দিকে; উরুগুয়ের ওরাসিয়ো কিরোগার হাত ধরে। পরে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হোর্হে লুইস বোর্হেসেরে হাত ধরে লাতিন গল্প বিশ্বসাহিত্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে শুরু করে। তারপরে আসেন জাদুকরী চতুষ্টয়- হুলিও কোর্তাসার, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, কার্লোস ফুয়েন্তেস এবং মারিয়ো বার্গাস ইয়োসা। তাঁদের হাত ধরে পল্লবিত হয় এক মায়াবী মহীরুহ- জাদুবাস্তবতা। এরপরে আরো অনেক লাতিন লেখকই তাঁদের কৃতী দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন এবং করে চলেছেন লাতিন গল্পের ধারা। তাঁদের সৃজন-ফসলে লাতিন গল্পের সমৃদ্ধির সাথে সাথে নিরন্তর ফুলেফেঁপে উঠছে বিশ্বসাহিত্যের অফুরান গল্পের ভা-ার।
লাতিন আমেরিকার গল্পের এই সমৃদ্ধ ধারার গুরুত্বপূর্ণ দশজন গল্পকারের এক ডজন গল্প সংকলিত হয়েছে গ্রন্থটিতে। গ্রন্থটি অবশ্য সুপরিকল্পিত নয়; বরং অনুবাদকের দীর্ঘ সময়ে কৃত অনুবাদগুলোর একটা সামগ্রিক সংকলন। তবে এই পরিকল্পনাহীন কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যে সংকলনটি দাঁড়িয়েছে, তাকেও একেবারে অপরিকল্পিত বলা যাবে না। কারণ পরিকল্পনাহীনতার পরও এটি লাতিন গল্পের একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংকলন হয়ে উঠেছে। সংকলনের দশ গল্পকারের মধ্যে যেমন আছেন লাতিন গল্পের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার ওরাসিয়ো কিরোগা, তেমনি আছেন তিন গুরুত্বপূর্ণ নোবেল বিজয়ী- গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, ওক্তাবিও পাস এবং মারিয়ো বার্গাস ইয়োসা। আছেন দুজন নারী গল্পকার- ক্লারিস লিস্পেক্তোর এবং ইসাবেল আয়েন্দে। লাতিনের অধিকাংশ দেশের ভাষা এস্পানিয়ল হলেও সেখানকার বৃহত্তম দেশ ব্রাজিলের রাষ্ট্রভাষা আবার পর্তুগিজ। সংকলনটিতে স্থান পেয়েছে সেখানকার সে-ভাষার একটি গল্পও- ক্লারিস লিস্পেক্তোরের ‘মুরগি’। এমনকি সময়ের হিসাব করলেও সংকলনটিকে প্রতিনিধিত্বশীল হিসেবে মেনে নিতে হয়; কারণ এটাতে যেমন আছে সেই শুরুর সময়ের কিরোগার গল্প, তেমনি আছে সম্প্রতি প্রয়াত এদুয়ার্দো গালেয়ানোর গল্পও।