
বাংলা গানের বর্তমান ও আরো
ড. করুণাময় গোস্বামীই ছিলেন বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের বাইরে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল উভয়ের সম্পর্কে গবেষণামূলক কর্মের জন্য পেয়েছেন সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক ও কলাম লেখক। প্রামাণ্য নজরুলসংগীত গবেষক। তিনিই প্রথম ইংরেজিতে নজরুলের পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনা করেন।
২০১৪-তে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স প্রকাশ করে তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধের সংকলন ‘বাংলা গানের বর্তমান ও আরো’। গ্রন্থটিতে ধারাবাহিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে গত একশ বছরের অধিক সময়ের বাংলা গানের ইতিহাস। বাংলা গানের অর্জন, ক্রমবিকাশ। পূর্ববাংলায় অথাৎ বর্তমান বাংলাদেশে রবীন্দ্র ও নজরল সংগীত প্রচার, প্রসার, প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রচলনের বিস্তারিত বিবরণ। সরল গদ্যে রচিত বইটি গবেষক তথা সংগীতমোদীদের কাছে একটি কোষগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। ৫৫০ পৃষ্ঠার গোছানো গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে ১১টি প্রবন্ধ। যার মধ্যে রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীত নিয়ে তিনটি করে ছয়টি প্রবন্ধ বিশেষ মূল্যমানের।
গ্রন্থের ‘বাংলা গানের বর্তমান’ শিরোনামের প্রথম প্রবন্ধ নিয়ে একটু কথা বলা যাক, এ রচনাটি কিছুটা স্মৃতিচারণমূলক। যেখানে লেখকের মুখে একটি বাস্তব গল্প শোনা যায়। আঙ্গুরবালার গানের আসরে এক শ্রোতা আঙ্গুরবালাকে বিশেষ একটা গান করতে বলেন। উত্তরে আঙ্গুরবালা ওই শ্রোতাকে বলেন, সেই গান তো আমার জীবনের প্রথমদিককার, সে গান কি এখন আর আপনাদের ভালো লাগবে? উত্তরে ওই শ্রোতা বলেন, গানে আমাদের যা কিছু সবই তো অতীত। প্রবন্ধের অন্য একটি অংশে আমরা চোখ রাখতে পারি Ñ রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলা নাগরিক গান রচনার ক্ষেত্রে কোন সংগীত আদর্শ হিসেবে কাজ করছে? জবাবে রবীন্দ্রনাথ বললেন, বাংলা গান রচনার যথার্থ আদর্শ হচ্ছে পদাবলী কীর্তন। ১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার জন্য পূর্ববাংলায় বা বর্তমান বাংলাদেশে আসেন। গ্রামীণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ পেয়ে যান সংগীতসৌন্দর্য বাউল গান। রবীন্দ্রনাথ বাউলে ঈশ্বরজিজ্ঞাসা, সর্বজনীন মনুষ্যভাবনা ও বাউলদের গান – এমন তিনটি জিনিস পেয়ে গেলেন।
বাংলাদেশেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গান করেন। ১৮৯০ সালে জমিদারি পরিচালনার জন্য শিলাইদহ আসেন। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর জীবনব্যাপী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শাহজাদপুর, পতিসর, শিলাইদহ ও পাবনা – এ চারটি স্থানে বসে অন্তত ৬৮টি গান রচনা করেন। ১৯২৬ সালে ঢাকাসহ কয়েকটি জনপদ ভ্রমণ করেন। ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রসাহিত্য পঠন ও রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষণ সম্পর্কে পূর্ববাংলায় ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করা। ১৯৬৩ সালে ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হলে ওয়াহিদুল হক রবীন্দ্রসংগীত প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা শুরু হয়।
বাংলা গানের পঞ্চাশ বছর শিরোনামের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গায়ক আবদুল আহাদ ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান, যিনি রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক হন। এ প্রবন্ধটির অন্য একটি অংশে পাওয়া যায়, রবীন্দ্রসংগীতের মতো নজরুলসংগীতের প্রতিও ঢাকার গায়ক সমাজে আগ্রহ তৈরি হয়। অবশ্য তখন নজরুল বয়সে তরুণ। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় নজরুল ইনস্টিটিউট। তাঁর গান উপস্থাপনের জন্য বিভাগ-পূর্ববর্তীকাল থেকেই প্রবল আগ্রহ ছিল ঢাকায়। বিভাগ-পরবর্তীকালে সে আগ্রহ প্রবলতর হয়। নজরুলের অসুস্থ অবস্থায় কলকাতা বেতার গ্রামোফোন কোম্পানিতে তাঁর গান সম্পর্কে আগ্রহ কমতে থাকে। দেশ বিভাগের ডামাডোলে তা আরো কমে আসে। কিন্তু স্বাধীনতার পরে নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলে পুনরায় শুরু হয় নজরুলসংগীতচর্চা। লেখক এ-অংশে আমাদের বলে গেছেন, রবীন্দ্রসংগীতের মতো নজরুলসংগীতচর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে যে ঢাকাকেই গণ্য করা হবে, সে বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া যায়।
বাংলা গান বর্তমানে একটি তীব্র সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সে না পারছে অতীত অর্জনের সূত্রকে সৃজনশীলভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে, না পারছে আফ্রো-আমেরিকান বা আফ্রো-ইউরোপিয়ান গতির উদ্যমে বলীয়ান সংগীতবুদ্ধিকে নিজের সঙ্গে যথার্থভাবে মিলিয়ে নিতে। বাংলা গান এখন না ঘরের, না ঘাটের। এ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন। আমি একটি ছোট্ট সূচনা করলাম। গ্রন্থে সংকলিত অন্য প্রবন্ধগুলোও বাংলা গানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকের ওপর আলোকপাত করবে।