
১৯৭১: যাঁদের রক্তে সিক্ত এই মাটি
১৯৭১। কী গরিমাময় একটি সংখ্যা! কী ভীষণ বেদনার্ত একটি সংখ্যা। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বছর। বাঙালির এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার বছর। দেশের জন্য বাঙালির আত্মবিসর্জনের বছর। সে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা তো প্রাণ উৎসর্গ করেই দিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা শহীদ হননি, যাঁরা যুদ্ধাহত, তাঁরা তো জীবন না হারিয়েও জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। বাকিটা জীবন শরীরে বহন করে চলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য। এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষ্য নিয়ে গ্রথিত সালেক খোকনের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ – ‘১৯৭১ যাঁদের রক্তে সিক্ত এই মাটি’।
গ্রন্থটির ভাবনা লেখকের মাথায় আসে ২০১০ সালে। সে বছরে বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে তাঁর আলাপ হয় দিনাজপুরের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাসের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর মাইনের আঘাতে তাঁর বাম পা উড়ে গিয়েছিল। এক পা নিয়েই বাড়ি-বাড়ি কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। তা নিয়ে তাঁর আক্ষেপ নেই। তাঁর আক্ষেপ অন্যত্র। বছর ঘুরে ঘুরে স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবস আসে, আর পত্রপত্রিকায় মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্য ছাপা হয়। কিন্তু তাঁদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের কথা অপ্রকাশিতই থেকে যায়। তাঁর কথাগুলো লেখককে ভাবিয়ে তোলে। সেই ভাবনা থেকেই তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তাঁর সেই কর্মযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সেই মৌলিক গবেষণাগ্রন্থটি পেয়েছিল ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’। তারই ধারাবাহিকতা এ-গ্রন্থ।
গ্রন্থটিতে মোট উনিশজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার গ্রন্থিত হয়েছে। সে-সব সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও আত্মত্যাগের গল্প, তাঁদের যুদ্ধ-পরবর্তী যুদ্ধাহতের জীবনগাঁথা, দেশ নিয়ে তাঁদের স্বপ্ন-আবেগ-আকাক্সক্ষা ইত্যাদি। এসেছে যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-, দালাল আইন বাতিল হওয়া, স্বাধীন দেশে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী বনে যাওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, চলমান রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠা প্রভৃতি ভালো লাগা-মন্দ লাগার প্রসঙ্গও। এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশে বিত্তবৈভবের গদিতে আসীন হওয়া তো দূরের কথা, কেউ-ই খুব একটা সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে তাঁরা হতাশ নন। আর নতুন প্রজন্ম নিয়ে তাঁদের নিশ্চিত আশাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাঁরা যে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন, নতুন প্রজন্ম সেই বাংলাদেশকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।