
ঘরে ফেরার গান ও অন্যান্য কবিতা
ডেভিড হোয়াইটের কবিতা আমাকে কেউ পড়তে দেয়নি। বলতে গেলে এইসব কবিতা অদেখা কুহরের মতো আমাকে তাঁর লেখার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। আন্তর্জালে প্রথম পেয়ে পড়তে পড়তে,পরে দূর মহাদেশ থেকে তাঁর বই সংগ্রহ করে বারবার পাঠে তাঁর রচনার সঙ্গে আমার দৈনন্দিন কথোপকথন থেকে এই কবিকে আমি হয়তো কিছুটা নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছি। যদিও তিনি নবীন নন, তবুও এই আবিষ্কার মহাদেশ আবিষ্কারের মতো অনবদ্য আমার কাছে। তাঁর সম্পর্কে আরেক সমসাময়িক ইংরেজ লেখক বলেছেন, হোয়াইট আমাদের কাছে কবিতাকে বাঁচামরার সামগ্রী করে তোলেন। হতে পারে এই কারণে তাঁর লেখা, যা শুধু আঙ্গিক নয় – অকুণ্ঠভাবে দার্শনিক এবং অভিজ্ঞান-সমৃদ্ধ, আমাদের এমন পূর্ণ এবং আলোকিত করে। আলোড়িত করে খুব কম। ঘুমের ভিতরে মানুষ যেভাবে কোনো চেষ্টা ছাড়াই স্বস্থ হয়, তেমন স্বাভাবিক স্বস্থতাই ডেভিডের কবিতায় ও লেখায় আমরা পাই – টলটলে, গহন আর নির্জন। অভিবাসী লেখক তিনি, নিঃসঙ্গতার মানচিত্র চিনে খুঁজে পান গৃহের মতো আকুল আশ্রয় । বাইরে থেকে আমরা বুঝি লেখাকেই আশ্রয় করেছে তাঁর পৃথিবীব্যাপ্ত জোয়ারী জীবন। আমরাও প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিকোণ পাই তেমন এক স্বকীয় গৃহ নিজের ভিতরে চিনে নেবার প্রস্তুতির। ডেভিড হোয়াইটের জন্ম ১৯৫৫ সালে, ইংল্যান্ডের এক পাহাড় আর উপত্যকার ঢেউ-ওঠা মানচিত্রে। ইয়র্কশায়ারে বড়ো হয়েছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর বাড়ি। সেখানকার রং-পাল্টানো আকাশ তাঁকে তাঁর ফেলে-আসা অন্য স্বদেশ আয়ারল্যান্ড, ইয়র্কশায়ার আর ওয়েলসের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি, লেখক, প্রকৃতিবিদ এবং বক্তা; তিনিই সম্ভবত একমাত্র কবি যিনি প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে সৃজনশীলতার প্রয়োগে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি কাজে লাগাতে পেরেছেন।
ডেভিড হোয়াইটের কবিতার বই সাতটি – ‘ঘরে ফেরার গান’ (Song of Coming Home, 1984), ‘নানা নদীর মোহনা’(Where Many Rivers Meet, 1990), ‘মাটির ভিতর আগুন’ (Fire in the Earth, 1992), ‘গৃহের মতো ঘর’ (The House of Belonging, 1996), ‘সবকিছু তোমার অপেক্ষায়’(Everything is Waiting for You, 2003), ‘পথিক’ (Pilgrim, 2012) এবং ‘তোমার অতল জল’(The Sea in You, 2015)।
একটি নতুন কবিতা সহ উপরের প্রায় সব ক’টি বই থেকে কিছু কবিতা নিয়ে নিজস্ব অনুভবের সূচিমুখে হেলান দিয়েই সাজানো হয়েছে এই বইয়ের চুয়াল্লিশটি কবিতার অনুবাদ। কবিতাগুলি কোন কোন বই থেকে নেওয়া হলো, তার উল্লেখ রয়েছে সূচিপত্রে।
এ ছাড়াও চারটি বিপুলখ্যাত গদ্যের বই আছে হোয়াইটের – ‘হৃদয় থেকে জেগে : কবিতা ও কর্পোরেট আমেরিকায় আত্মার সংরক্ষণ’ (The Heart Aroused: Poetry and the Preservation of Soul in Corporate America, 1994), ‘অজানা সাগরপাড়ি : কাজ যেখানে আÍপরিচয়ের পথ’ (Crossing the Unknown Sea: Work as a Pilgrimage of Identity, 2001), ‘তিন পরিণয়: কাজ, আত্ম ও সম্পর্কের পুনর্ভাবনা’ (The Three Marriages: Re-imagining Work, Self and Relationship, 2009) এবং ‘সান্তনা: দৈনন্দিন শব্দের আশ্বাস, পুষ্টি ও অন্তর্লীন অর্থময়তা’ (Consolations: The Solace, Nourishment & Underlying Meaning of Everyday Words, 2005)|। এই বইগুলি, এবং তাঁর বিখ্যাত অডিও ও ভিডিও বক্তব্যের সিডি এখন মেনি রিভার্স প্রেস থেকে পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্র প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে তাঁর ডিগ্রি আছে, আছে পেনসিলভেনিয়ার নয়ম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সম্মানসূচক ডিগ্রি, এ ছাড়া তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইদ স্কুল অব বিজনেসের একজন অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
ডেভিড হোয়াইট সারা পৃথিবী ঘুরে তাঁর কবিতা ও বক্তব্য পরিবেশন করে থাকেন। আমি তাঁর অনেকগুলি আলোচনার ভিডিও দেখেছি। বক্তা হিসেবে কেন তিনি এমন সর্বজনপ্রিয় সেই সব আলোচনা থেকে কিছুটা যেন উপলব্ধি করা যায়। এবং অনুভব করা যায়, কেন নিজের ভুঁই থেকে বিচ্ছিন্ন, প্রযুক্তিনির্ভর আজকের নাগরিক মানুষের এমন এক কবিকে প্রয়োজন। এবং আর্থিক, মানসিক সংকট থেকে স্বাধীন হবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, সামাজিক ও সাহিত্যিক সমাবেশ, এমনকী বোয়িংয়ের মতো বহুজাতিক কো¤পানির ওয়ার্কশপ ও আলোচনায় বক্তব্য রাখার জন্য তাঁর মতো একজন লেখক কেনই বা জরুরি।কথায় বলে, যখন আমরা প্রস্তুত হই মহাবিশ্ব তখন কোত্থেকে যেন হাত বাড়িয়ে আমাদের হাতে স্বয়ং তার মণিরতœ দান করে। লেখক ডেভিড হোয়াইটকে মহাবিশ্ব সেই মুহূর্তে আমার হাতে এনে দিয়েছে যখন আমি সেই রত্নকে দেখে নিজের বলে চিনতে পেরেছি।হোয়াইটের কবিতার অনুবাদ শুরু করি ২০১৬ সালে, কিন্তু বেশির ভাগ অনুবাদ ২০১৭-এর শেষ দিকের। বেঙ্গল পাবলিকেশনস-এর নির্বাহী পরিচালক শ্রদ্ধেয় আবুল হাসনাত এই কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশে আগ্রহী হয়েছেন নিজে থেকে। কয়েকটি কবিতা তাঁর স¤পাদিত সাহিত্যপত্র ‘কালি ও কলম’-এও ছাপা হয়েছিল। আমি তাঁর কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। এই সংকলনের আরো কিছু অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর’-এর ‘আর্টস’ বিভাগে এবং ‘পর¯পর’ ওয়েবজিনে। এই সুযোগে রাজু আলাউদ্দিন ও মাজুল হাসানকেও কৃতজ্ঞতা জানাই।
নানা সময়ে মূল্যবান মতামত দিয়ে আমার নির্জন অনুবাদকে সাহায্য করার জন্য অনেক শুভানুধ্যায়ী পাঠকের কাছেও আমি গভীরভাবে ঋণী। যেমন ঋণী আমি আমার মা-বাবার কাছে, সবকিছুর জন্য; ঋণী আমার ভাই আর পুত্রের কাছে তাদের স্বর্গীয় অস্তিত্বের জন্য; ঋণী অভিভাবক কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক আর জ্ঞানতাপস সনৎকুমার সাহার কাছে, তাঁদের সূর্যতারার মতো হৃদয়ের দানের জন্য। কিছু কিছু ঋণ শোধবার নয়। আমরা এই রকম ঋণী থাকতে পারলে বেঁচে যাই!
অনুবাদের মধ্যে মূল কবিতার সুর কতটা এসেছে বলতে পারি না। বইয়ের দিক থেকে যে-কোনো ভুলত্রুটির জন্য আমি পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ডেভিড হোয়াইটের কবিতা যদি বাঙালি পাঠকের কাছে কিছুটাও পৌঁছয় তবে বড়ো খুশি হব।
আনন্দময়ী মজুমদার