
জীবনানন্দ দাস : কারু-বাসনা মূলানুগপাঠ
কারু-বাসনা: মূলানুগ পাঠ, সম্পাদনা ভূমেন্দ্র গুহ। বেঙ্গল পাবলিকেশনস প্রকাশিত রয়েল সাইজের ১৪৪ পৃষ্ঠার এই বইটির ১১৩ পৃষ্ঠাজুড়ে আছে উপন্যাস, বাকি অংশে রয়েছে ভূমেন্দ্র গুহের রচনা, যা উপন্যাসের ভিতরকার বিষয়-শব্দ সংশ্লিষ্ট, টীকাও বলা যায়।সব শেষে আছে তথ্যসূত্র। ১৯৩৩ সালে রচিত বইটির এই সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী রফিকুন নবী।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হেম, এক মধ্যবয়স্ক বেকার। কলকাতায় মেসে থেকে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে সর্বস্বান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে বাড়িতে এসেছে। পরিবার চালান প্রায় ৬৫ বছর বয়স্ক স্কুল শিক্ষক বাবা। চরম অভাবের সংসার। পরিবারে আছে হেমের স্ত্রী কল্যাণী, কন্যা খুকু, মা। অতিথি হিসেবে উটকো উপস্থিত আছেন এক কাকা ও এক পিসিমা। অনেকটা মনোলোগের মতোই উপন্যাসের বর্ণনা।বাকি সংলাপ হেমের সঙ্গে পরিবারের বাকি সদস্যদের।
বাবা ছেলের বেকারত্ব নিয়ে চিন্তিত হলেও জীবন নাভিশ্বাস হবে এমন পেশা বেছে নিতে বারণ করেন। কিন্তু অভাবগ্রস্ততায় ইচ্ছাপূর্বক উপোস থাকা, স্বামীর সঙ্গে এক রুমে না থাকা ইত্যাদি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় হেমের জীবনযুদ্ধে পরাজয় তার জীবনকেও অর্থহীন করে তুলছে। স্ত্রী কল্যাণীর কাছে তার প্রাক্তন প্রেমিক নির্মলের অসুস্থতার খবর আসে চিঠিতে। নির্মলের জন্য বিচলতা দেখে হেম ভাবতে থাকে তার ভালোবাসার বনলতার কথা, বনলতা মৃত্যুশয্যায় তাকে স্মরণ করবে কিনা। হেমের বিশ্বাস, কখনই এই অকর্মাকে স্মরণ করবে না বনলতা।
‘কারু-বাসনা’র শুরুটা চমকে যাওয়ার মতো : ‘ফিরে চেয়ে দেখলাম সে দুধের দিকে সতৃষ্ণভাবে তাকিয়ে আমার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে, হাতভরা তার অনিচ্ছা ও অনগ্রসরের অসাড়তা; মুখখানা হেমন্তের সন্ধ্যার মতো হিম, বেদনাতুর; মৃত সন্তানের মুখের ওপর নিবদ্ধ মৃতবৎসা হরিণীর মত বিহ্বল বিষণ্ন চোখ।’ মাত্র আধগ্লাস দুধপানের ব্যাপার। তার মধ্যদিয়ে দারিদ্র্য ও আত্মপ্রেমের কারণে গাঢ় হয়ে ওঠা দাম্পত্য জীবনের শীতলতার ছবি কী নির্মোহ সততার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে তা বলা বাহুল্য। এমন তীব্র সত্যের উপলব্ধি অনেক প্রথাগত মানুষের পক্ষেই মেনে নেয়া বড় কঠিন। দেখা যায়, দুধের গ্লাসটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। ভাঙা টুকরোগুলি কুড়িয়েও নেয়া হয়। গ্লাসটি হয়তো ক্ষণভঙ্গুর দাম্পত্য জীবনেরই আড়াল, মুখোশ। মুহূর্তেই যা ভেঙে পড়ে। তবে দুধটুকুই বা কি? পুরো নয়, আধগ্লাস দুধ। সেটি কি তবে অর্ধপূর্ণ জীবনের মাঝে একটু আধটু জাগতিক প্রাপ্তির ছিটেফোঁটা। এসব ছাপিয়ে তীব্র সত্য হলো, এই দুধটুকু নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর লোভ ও ত্যাগের প্রগলভতার মধ্য দিয়ে জীবনের সারশূন্য লোলচর্ম মূর্তি অলক্ষ্যে বেরিয়ে পড়ে।
সবশেষে এটা বলা চলে যে, যেহেতু ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত ‘কারু-বাসনা’ উপন্যাসের এই সংস্করণটি মূল পাণ্ডুলিপি অনুসারে মূলানুগ পাঠের মধ্য দিয়ে গ্রন্থিত হয়েছে সেহেতু এটিকে আমরা সর্বশেষ নির্ভুল একটা গ্রন্থ বলতে পারি।