
জয়নুল আবেদিন: জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি
‘জয়নুল আবেদিন: জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।’ এটা একটা স্মারকগ্রন্থের মতোই। বইটি অতিশয় যত্ন নিয়ে সম্পাদনা করেছেন সৈয়দ আজিজুল হক। উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী ও আবুল হাসনাত।
বইটির জন্য নির্বাচিত লেখাগুলির কোনো কোনোটি নতুন, কোনো কোনোটি পুরনো লেখার নতুন পরিমার্জনা, তবে অধিকাংশই পুরনো। যেমন বইটিতে সবচেয়ে পুরনো যে লেখাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার লেখক ভারতের বামপন্থী ধারার কবি ও ঔপন্যাসিক গোলাম কুদ্দুস। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ-উত্তর দশকের পটভূমিতে জয়নুলকে মূল্যায়নের একটি প্রয়াস এ লেখায় রয়েছে। তারপর কলকাতা আর্ট স্কুলে জয়নুলের ক্লাসমেট শফিকুল আমীন তাঁকে নিয়ে লেখেন ১৯৯২ সালে, সেই লেখাটি বইটিতে আমরা পাই। ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে করাচিতে অনুষ্ঠিত জয়নুলের একক চিত্র প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে সেখানকার ডন পত্রিকায় ২৩ অক্টোবরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ লেখেন : ‘জয়নুল আবেদিন : আ ভিকটিম অব কনফ্লিকটিং আইডিয়াস’ (জয়নুল আবেদিন : স্ববিরোধী ধারণার বলি)। এর উত্তরে একই পত্রিকায় পাকিস্তানের শিল্পসমালোচক এস. আমজাদ আলি লেখেন : ‘জয়নুল আবেদিন : আ ভিকটিম অব ফ্রাংক ক্রিটিসিজম’ (জয়নুল আবেদিন : অকুণ্ঠ সমালোচনার বলি)। এ দুটি বিতর্কমূলক আলোচনা বইটিতে সংকলিত। আরো আছে বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমান ১৯৬৩ সালে জয়নুল আবেদিনের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তা বিবিসি রেডিও-তে প্রচার করেছিলেন, সেটা।
আবু জাফর শামসুদ্দীন ছিলেন জয়নুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তিনি ১৯৪৬ সালে জয়নুলের বিয়েতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। সেসব নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর আত্মস্মৃতি গ্রন্থে। সেই স্মৃতিচারণাও এই বইতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ছাত্র হলেও কামরুল হাসান কলকাতার জীবনে জয়নুলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জয়নুলের মৃত্যুর দশ বছর পরে ১৯৮৬ সালে সেই অন্তরঙ্গ সম্পর্কসূত্রে জয়নুল-জীবনের বয়ান তিনি উপস্থাপন করেছেন ‘আমার মাস্টার মশাই : জয়নুল আবেদিন’ শীর্ষক এক দীর্ঘ রচনায়। সেই লেখাটিও বইটিতে আমরা পাই।
শওকত ওসমান তাঁর ‘ঝড়-তুফানের জঙ্গী কমরেড’ শীর্ষক রচনায় উপস্থাপন করেন জয়নুলের কলকাতা-পর্বের জীবনযুদ্ধের কাহিনী। পূর্ণেন্দু পত্রীর যে লেখাটি গ্রন্থভুক্ত হয়েছে সেটির শিরোনাম ‘জয়নুল আবেদিন : আমার দ্রোণাচার্য’, এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। তিনি জয়নুলের ছবি দেখে যে নতুন একটি টেকনিক শেখেন তার ঋণ স্বীকার করেন এ লেখায়। বইটিতে আরো আছে ১৯৯৩ সালেই প্রকাশিত ওয়াহিদুল হক, বুলবন ওসমান ও মতলুব আলীর প্রবন্ধ। ওয়াহিদুল হক বলেছেন জয়নুলের দরদি তুলির স্পর্শে বাংলার অন্তর চিত্রণের কথা; বুলবন ওসমান লিখেছেন এদেশে চারুশিল্প প্রতিষ্ঠায় জয়নুলের অসামান্য অবদানের গাথা; আর মতলুব আলী বিশ্লেষণ করেছেন জয়নুলের স্বদেশ-সাধনার মর্মার্থ। কাইয়ুম চৌধুরীর ‘জয়নুল আবেদিনের ড্রইং’ শীর্ষক লেখাটিতে তিনি জয়নুলের ড্রয়িংয়ের শক্তির দিকটি বিশ্লেষণ করেন। আবুল মনসুর জয়নুলের চিত্রে আবিষ্কার করেছেন রেখার দীপ্র পদচারণা। আবুল হাসনাত ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটটি যথার্থভাবে উন্মোচন করেছেন। এমন আরো অনেক গুণী ও জয়নুলের কাছের মানুষের মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণমূলক রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে বইটি।
পরিশেষে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে এই অবধি লেখা সবচেয়ে ভালো রচনাগুলির একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংকলন হচ্ছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত এই বইটি।