
দ্বিমনদিশা
শূন্য দশকের সবচেয়ে দেদীপ্যমান কবিদের একজন শুভাশিস সিনহা। তার সমকালীন কবিরা যেখানে অনেকেই দুর্বোধ্য ও বিমূর্ততার দিকে যাওয়ার চেষ্টায় রত, সেখানে তিনি সহজ কথা সহজে বলার চেষ্টা করেন। আর এখানেই তারশক্তি। তিনি নিয়ত পরিবর্তনের মধ্যে চিন্তার, কল্পনার ও নির্মাণের ব্যাপক স্বাধীনতা যেমন নিয়েছেন; সেই সঙ্গে কবিতায় স্মার্টনেসের আড়ালে কাব্যিক আশাও পাকাপোক্ত করেছেন। ফলত তার সরল এবং গীতিময় একটা ধরন গড়ে উঠেছে। তার এই ‘দ্বিমনদিশা’ নামের কবিতার বইটাতেও আমরা তার স্বাক্ষর দেখি। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন মাহমুদুল হক। এই বইয়ে একই মলাটে ২টি পর্বে কবিতাগুলি বিন্যস্ত। প্রথম পর্ব ‘হৃদস্পন্দনের পঙক্তিনাচনে’ কবিতা রয়েছে ২৬ টা আর দ্বিতীয় পর্ব ‘শোণিতপথের কথারেখা’তে রয়েছে বাকি কবিতাগুলি। তাহলে ৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে মোট কবিতা রয়েছে ৫২টি। বইটির দাম রাখা হয়েছে ১০০ টাকা।
শুভাশিস সিনহার ‘দ্বিমনদিশা’ গহীনের দ্বিধা ও ধূম্রবাসনার চক্রব্যূহ। দ্বিমনদিশা শব্দটি মনিপুরি ভাষার শব্দ। এর অর্থ দ্বিধা।
এই কবির কবিতায় নিজের চেনা জগৎটাকেই বারবার ভালোবেসে নতুন নতুন করে দেখি। অনুভূতি, বোধ ও শব্দের সম্মিলনে সৃষ্টি হয় কবিতা। কবির নিজের আবেগের একটা শুদ্ধতা আর সততার বোধ হয় দরকার আছে। সেটা এই কবির কবিতায় পাওয়া যায়। তার কবিতায় যেমন পাই একান্ত অনুভূতি, সমকালীন সমাজ ও জীবনের ছবি, তেমনি পাই এক সুনিপুণ শিল্পীকে, যিনি শুধু কবিতা শোনান না, কবিতাকে করে তোলেন শিল্পরূপময়। কবি যেন তাঁর অন্তরের অনুভূতিগুলোকে নানা কোণ থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছেন। তবে এই দেখার একটা বিশেষত্ব হলো- কথাগুলো কেবল নিজের হয়েই থাকেনি, এর সাথে গেঁথে দিয়েছেন মানবিক অনুষঙ্গকে। যেমন ‘পাখিরা’ কবিতায় কবি যেন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যাত্রা করতে চান। জীর্ণ, ক্লেদাক্ত সময়খণ্ডে দাঁড়িয়েও তিনি স্বপ্ন দেখেন সুন্দর পৃথিবীর।
এভাবেই কবি কখনো নিজের অন্তরের কথাকে ভাষারূপ দেন আবার কখনো সমকালীন সমাজের বিচিত্র রূপকে মূর্ত করে তোলেন কবিতার শরীরে। কবিতাগুলো তখনই হয়ে ওঠে ক্রান্তিকালের স্বরলিপি। কোনো সন্দেহ নেই, সহজ-সরল ও গভীর ভাষাভঙ্গি এবং সাবলীল উপস্থাপনা কবিতাগুলোকে করে তুলেছে শিল্পরূপময়। সমকালের কবিতার ভাষায় তিনি কবিতা নির্মাণ করেন। পাঠকের বোধ ও অনুভবকে তাই সহজেই ছুঁয়ে দিতে পারেন তিনি। ব্যক্তিমানসকে অতিক্রম করে কবিতাগুলি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। শুভাশিসের কবিতার এটাই বিশিষ্টতা।