
ভাইস চ্যান্সেলর ও অন্যান্য গল্প
আন্দালিব রাশদীর উপন্যাস মানেই গতিময় এক রোমাঞ্চকর জার্নি। তাঁর উপন্যাস একবার শুরু করলে শেষ না করে ওঠা মুশকিল। এই রস থেকে বঞ্চিত নয় তাঁর অনুবাদকর্মও। অনুবাদকে যদিও অনেকে মৌলিক সাহিত্য হিসেবে মানতে চান না; কিন্তু অনুবাদ না হলে বিশ্বসাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মের সন্ধান আমরা পেতাম না।তবে অনুবাদের দুর্বোধ্যতা এবং অপ্রাসঙ্গিকতার কারণে বেশিরভাগ সময়ই অসামান্য সেসব কাজের মূল বক্তব্যটুকু বাইরেই রয়ে যায়। অবশ্য আন্দালিব রাশদীর অনুবাদের বই ‘ভাইস চ্যান্সেলর ও অন্যান্য গল্প’ আমাদের ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে। এখানে কেবল অনুবাদের গতিময়তা এবং স্বতঃস্ফূর্ততাই নয়, বরং তাঁর গল্প নির্বাচনের যে মু্নশিয়ানা তাও আমাদের সমান মুগ্ধ করে।
গল্পের কথা বলার আগে মূল গল্পকারদের নামগুলোর দিকে তাকালেই আমাদের আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়।যা আমাদের গল্পের ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। টি ভি ভার্কে, আজিজ নেসিন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ থেকে ইসমত চুঘতাই, গুন্টার গ্রাস কিংবা লেভ তলস্তয় – এক গ্রন্থে হাজির হয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের সব দিকপাল। যাঁদের সাহিত্যপাঠ বরাবরই এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা।এই বইয়ের গল্পগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়। যেমন নামগল্পটি ধরা যাক। ‘ভাইস চ্যান্সেলর’ নামক সেই গল্পে এমন একজনের কথা বলা হয়েছে যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু সে প্রতিযোগিতায় জিতে আসা এত সহজ নয়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শিক্ষক হওয়ার পরও নিস্তার নেই। এরপর আছে এক গ্লানিময় অথর্ব জীবন। ভারতীয় খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক টি ভি ভার্কের এই গল্পটি যেন আমাদের এখানকার প্রেক্ষাপটেই রচিত। পড়তে পড়তে মনে হবে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যপটও এরচেয়ে ব্যতিক্রম কিছু নয়। এই বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটি তুর্কি লেখক আজিজ নেসিনের ‘ছাদের ওপর একটি পাগল’। এটি মূলত একটি পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। পাগলের রূপকে রাজনীতির উত্থান-পতনকে এখানে তুলে ধরেছেন লেখক। যা আন্দালিব রাশদীর সুনিপুণ অনুবাদে আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আন্দালিব রাশদী এই বইয়ে অনুবাদ করেছেন নোবেল বিজয়ী কিংবদন্তি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘অতিকায় ডানাওয়ালা এক বুড়ো’ নামক বহুলপঠিত গল্প। মার্কেজের নিজস্ব জাদুবাস্তবতার ঢঙে লেখা এই গল্পে মার্কেজ মনুষ্য সমাজে অতর্কিত এসে পড়া এক দেবদূতকে ঘিরে তৈরি হওয়া কৌতূহল নিয়ে লিখেছেন। যে দেবদূত কিনা মর্তে এসে নানা ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়ে। পরে একটি শিশুর সাথে দেবদূতও জলবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। শেষ তার ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে গল্পটি শেষ হয়। রাশদীর অনুবাদে এ গল্প পড়তে পড়তে মৌলিক গল্পের স্বাদই যেন পাওয়া যায়। ‘দেশের জন্য যুদ্ধে নেমে কারো দুই ছেলের একটি নিহত হওয়া উত্তম, না যার একটি মাত্র ছেলে সেই ছেলেটি নিহত হওয়া উত্তম?’ এইরকম একটি প্রশ্নের মাধ্যমে শেষ হয়েছে ইতালিয়ান লেখক লুইজি পিরানদিল্লোর পৃথিবী কাঁপানো গল্প ‘যুদ্ধ’। মূলত যুদ্ধের নৈতিকতা এবং ভয়াবহতাকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে লেখা হয়েছে এই গল্পে। নিরপরাধ হয়েও সাজাপ্রাপ্ত আক্সিনিয়ভকে নিয়ে এই বইয়ের শেষ গল্প ‘ঈশ্বর সত্যিটা দেখেন, কিন্তু অপেক্ষা করেন’ – সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন লেভ তলস্তয়ের।রাশদীর অনুবাদে এই গল্পটি পড়ার অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার রেশ রয়ে যায়। বারবার মনে হয় আক্সিনিয়ভ কি আসলেই বাঁচতে পারতেন না? এছাড়া ইসমত চুঘতাইয়ের ‘গৃহবধূ’, গুন্টার গ্রাসের ‘ফ্লাউন্ডারের প্রথম কাহিনী: তৃতীয় স্তন,’ মারিও বার্গাস ইয়োসার ‘আন্ট জুলিয়া,’ ওরহান পামুকের ‘দূরের সম্পর্ক’-এর মতো অনবদ্য ২০টি গল্পে সাজানো হয়েছে বইটি, যা অনুবাদক আন্দালিব রাশদীর জাদুকরী অনুবাদে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবে পাঠককে।