
রনবীর বিশ্বদর্শন ও রম্যকথন
‘রনবীর বিশ্বদর্শন ও রম্যকথন’ বইটির লেখক রফিকুন নবী প্রথমেই ভূমিকায় বলে নিয়েছেন, না কোনো জ্ঞানগর্ভ লেখনী হয়েছে, না কোনো সৃজনশীল কিছু। ভ্রমণ নিয়ে লেখা বটে কিন্তু পুরোপুরি ভ্রমণকাহিনিও নয়। যেটুকু হয়েছে তাকে খুব জোর ভ্রমণ-সংক্রান্ত স্মৃতিচারণমূলক লেখা বলা যেতে পারে। তবে খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, আদি থেকে যদি ডিটেইলে সব ভ্রমণের আদ্যোপান্ত লেখা থাকতো, এখন তা কাজে লাগতো।’
রফিকুন নবী এদেশের সৃজনশীল ব্যক্তিদের অন্যতম, যিনি বেশ কয়েক দশক জুড়ে বাংলাদেশের শিল্পকলার জগৎকে নানাভাবে বর্ণাঢ্য করে তুলছেন। সৃষ্টি করেছেন অমর এক কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই – যা শুধু আজ বাংলাদেশেরই নয়, হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীরই ছিন্নমূল শিশুদের আইকন প্রতিনিধি। টোকাই’-স্রষ্টা ছাড়াও তিনি জলরং, তেলরং মাধ্যমের একজন বিশিষ্ট শিল্পী, যিনি নিজের একটি আলাদা চিত্রভাষা তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন।
রফিকুন নবী ভূমিকায় যা-ই বলুন, রনবীর বিশ্বদর্শন ও রম্যকথন বইটি মূলত ভ্রমণকাহিনিই এবং এক-দুটি ভ্রমণ ছাড়া প্রায় প্রতিটি ভ্রমণের উপলক্ষই শিল্পকলা। কখনো শিল্পকলার পণ্ডিত হওয়ার দীক্ষা নিতে ছুটে গিয়েছেন গ্রিস, কখনো চিত্র-প্রদর্শনীতে অংশ নিতে যুগোস্লাভিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউইয়র্ক, বেইজিং, মেক্সিকো, আগরতলা, ওমান, মালদ্বীপ, জাপান, লন্ডন, রাশিয়া, চেকস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়ায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। কখনো বা আর্ট ক্যাম্পে যোগ দিতে উপস্থিত থেকেছেন ভারতের পন্ডিচেরি, ইতালি, নেপাল ও ভুটানে। তবে শিল্পকলার বাইরে যে উপলক্ষে আর কটি ভ্রমণে তিনি গিয়েছেন, সেখানে কাকতালীয়ভাবে যোগ রয়েছে বিয়ের। শিল্পী হাশেম খান আর কথাসাহিত্যিক বুলবন ওসমানের সঙ্গে ভারতে যে প্রথম ভ্রমণটিতে গিয়েছিলেন, তার ইচ্ছেটির পেছনে ছিল দুটি কারণ Ñ এক, বিয়ের আগে ফ্রি-ফ্র্যাংক ব্যাচেলর জীবনটাকে শেষবারের মতো উপভোগ করে নেওয়া, আর দুই, নিজের বিয়ের জন্য বেনারসি শাড়ি কেনা। এছাড়া গ্রিসে থাকাকালে তাঁর মিশর, ইতালি, সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সে বেড়ানোর যে-সুযোগ এসেছিল তার মধ্যে একটি ছিল ভারতীয় বন্ধু বালু ঠাকুরের বিয়ে-পরবর্তী হানিমুন-কার্যক্রমে উপযুক্ত সংগত দেওয়া। তবে সংগত দিতে গিয়ে যে উলটো অভিজ্ঞতা হলো, তিনি সেই কাহিনির শিরোনাম দিয়েছেন- আমি হলাম পথের কাঁটা/ মধুচন্দ্রিমার কপাল ফাটা’। এমন মজার ঘটনার ছড়াছড়ি রয়েছে বইটির প্রতিটি অধ্যায় জুড়ে। তাই এটি হালকা চালের বই নয়, একটি ভ্রমণকাহিনির ভেতর দিয়ে একটি দেশকে, দেশের মানুষকে, সে-দেশের বৈশিষ্ট্যকে যে জানার ব্যাপার আছে, তা কোনো কোনো লেখায় গভীরভাবেই ফুটে উঠেছে। কোনো কোনো লেখায় বলছি এ-কারণে যে, কোনো কোনো ব্যাপার হয়েছে খুবই স্বল্পকালীন সময়ের জন্য। তা আবার তার পুরো সময়টিই কেটেছে চিত্র-প্রদর্শনী কিংবা আর্ট ক্যাম্পের কর্মকা- নিয়ে। সেখানে দেশ দেখবার ফুরসতই বা কোথায় আর মানুষ দেখবার সময়ই বা মেলে কীভাবে। সংগত কারণেই সেটা রনবীর কাছে আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু যেখানেই তিনি একটু বেশি সময় অবস্থান করেছেন, সে জায়গার নাড়ি-নক্ষত্র তুলে ধরেছেন, জাতটা নিংড়ে বের করে এনেছেন।