রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন আ ডে
কবিতা অনেকরকম – এই কথা জীবনানন্দ দাশের। এই কথার সূত্র ধরেই হয়তো জীবনানন্দের পরবর্তী সময়ে অনেকেই কবিতায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় বৈচিত্র্য এসেছে ভাষায়, বিষয়ে এবং আঙ্গিকে। সাথে সাথে বদল ঘটেছে পাঠকের রুচিরও। তেমনই একটি বই টোকন ঠাকুরের ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন আ ডে।’ এই বইয়ের নাম পড়ে শুরুতে পাঠককে একটু থমকে দাঁড়াতে হয়। একটু সময় নিতে হয়। বইয়ের নাম এবং প্রচ্ছদ দুটোই সে মনোযোগটুকু আশা করে। কবিতার নাম এবং প্রচ্ছদ সাধারণত আমাদের কাছে কবিতা সম্পর্কে যে ধারণা দেয়, এই বই সেদিক থেকে একটু ভিন্ন। প্রথম দেখায় যদি কেউ এই বইটিকে কবিতার বই বলে বুঝতে না পারে তবে তাকে মোটেই দোষ দেয়া যাবে না। কিন্তু এটুকু পার হলেই চার ফর্মার এই বইয়ে আছে নানা রং এবং রূপের সম্মিলন।যা টেনে ধরে রাখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এই বইয়ের প্রথম কবিতাতেই লেখা হচ্ছে, ‘যখনই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি/ তরু, তখনই তুমি পাখি হয়ে যাও।’ এক আশ্চর্য ইমেজের ধাক্কায় যেন আমাদের কবিতা পাঠ শুরু হয়। তবে আরো গভীরে যেতে যেতে আমরা বুঝতে পারি সেটা কেবল শুরু ছিল। যেন রোম শহরের গড়ে ওঠাকে দৃশ্যের পর দৃশ্য দিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরছেন কবি টোকন ঠাকুর। সেই সাথে এই বইয়ের কবিতায় নিজেকেও যেন কিছুটা বুঝে নিতে চেয়েছেন কবি। একটু সময় দিয়ে তাকাতে চেয়েছেন নিজের দিকে। ‘অটোবায়োগ্রাফি ০১’ শিরোনামের তিন লাইন এক কবিতায় কবি বলছেন, ‘খড়ি হতে চেয়েছিলাম/কিন্তু কী বুঝলে কুক্ষণে যে হয়ে পড়লাম খড়।/আর তক্ষুণি উঠল ঝড়।’ কবিতার আড়ালে কবি যেন বারবার নিজেকেই খুঁড়ে দেখতে চেয়েছেন। নিজেকে খোঁজার এই জার্নি যে সহজ নয় আমরা তা বুঝতে পারি যখন পড়ি, ‘শুনেছি কবিরা গোসল করে না, আঙুলের নখ কাটে না। আমি খুব স্নানপ্রিয়, আমি নখ কাটতে গিয়ে নিজের আঙুল কেটে ফেলি। কাটা জায়গায় ডেটল লাগাই।’ এই আলাপ কবির সাথে কবির নিজের।এটাকে কবি টোকন ঠাকুর আবার উল্লেখ করছেন ‘মোহ’ বলে। এই বইয়ের পরতে পরতে রয়েছে চমক। যা কবিতা পাঠের পরও পাঠককে আটকে রাখে অনেকক্ষণ। যেমন এক জায়গায় কবি লিখছেন, ‘হঠাৎ এমন হার্ট অ্যাটাকিং, হঠাৎ হলাম খুন/‘তাহলে হোক’…শিস বাজালেন নির্মলেন্দু গুণ’। কবিতার এই পাঠ আমাদের গতানুগতিক পাঠ থেকে কিছুটা ভিন্ন। তবে নব্বই পরবর্তী বাংলা কবিতার যে বাঁকবদল তার সাথে মিলিয়ে পড়লে এই পাঠ আবার একেবারে অপরিচিতও মনে হবে না। আবার সাম্প্রতিক সময়ের দুর্বোধ্য ইমেজসর্বস্ব এবং অ্যাবস্ট্রাকশনে ভরপুর কবিতার মতো টোকন ঠাকুরের এইসব কবিতা আক্রান্ত নয়। এখানে যেমন ইমেজ আছে, আবার নানা অসংগতির প্রতি স্যাটায়ারও আছে। তবে তা মোটেই কবিতাকে আড়াল করে নয়। এক জায়গায় কবি বলছেন, ‘জাতিসংঘ পারবে না, তুমি পারবে, আমাকে তুমি/ তোমার কালো তিল-আফ্রিকার ভিসা দাও/আমি ভ্রমণে যেতে চাই।’ আরেক জায়গায় কবি লিখছেন, ‘গাছকে বলেছি, ভাই।/না হলে কি আর বনজঙ্গলে থাকা যায়?’ এভাবে বৈচিত্র্যময় এক কবিতাজগতের উন্মোচন ঘটেছে এই বইয়ে। যেখানে চমক, বিষাদ এবং স্যাটায়ার মিলেমিশে অন্যরকম এক কবিতার সন্ধান দেয় পাঠককে। যার রেশ রয়ে যায় আরো অনেকদিন পর্যন্ত।