
লাতিন আমেরিকার ছোটোদের গল্প বড়োদেরও পড়বার
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত ও তর্জমাকৃত ‘লাতিন আমেরিকার ছোটোদের গল্প বড়োদেরও পড়বার’ মূলত কয়েকটি লাতিন আমেরিকার ছোটগল্পের সংকলন। গেল শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে লাতিন লেখকেরা জাদুবাস্তবতার মোহিনী ছন্দে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এক-দুই বছরের মধ্যে হুট করে কিন্তু এই ‘লাতিন বুম’ ঘটেনি, এর পেছনে ছিল আরো বহু বছরের অক্লান্ত সাধনা। লাতিন মহাদেশটাই যেন এক অদ্ভুত মায়াজালে ঘেরা, বৈপরীত্যে ভরা প্রাকৃতিক নৈসর্গ, সামরিক জান্তার বুটের দাপট, গুটিকয় মানুষের বিত্ত-বৈভব, বিপ্লবীদের আনাগোনা – সবই এই বিরাট ভূখণ্ডটিকে আমাদের খুব কাছের করে দিয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক এই সংগ্রামের রূপটি যে কেবল বড়দের জন্য প্রযোজ্য লেখনীতে উঠে এসেছে তাই নয়, ছোটদের জন্য লেখা গল্পগুলিতেও পদে-পদে রূপক বা আক্ষরিকভাবে এসেছে শতকব্যাপী এই আন্দোলনের নির্যাস। আর তাই লাতিন লেখকরা ছোটদের জন্য যা লিখে গিয়েছেন, তাতে বড়দেরও ভাবনার রসদ পাওয়া যায় বইকি।
মোট ১৪টি ছোটগল্পের সংকুলান হয়েছে ‘লাতিন আমেরিকার ছোটোদের গল্প বড়োদেরও পড়বার’ গ্রন্থটিতে। উরুগুয়ের রহস্যমণ্ডিত লেখকের প্রসিদ্ধ ব্যাঘ্রপুরাণ যাতে উয়ান দারিয়েন নামক বাঘ ও মানুষের দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে, আছে মুরগিছানা আর বিষণ্ন একটি দম্পত্তির গাথা, আর আছে নিজেদের নিভৃত জীবনাচারকে রক্ষার জন্য কুমিরদের সংগ্রাম এবং সাপেদের আয়োজিত এক বলনাচের আসরের কথা, যাতে অংশ নেওয়ার মাশুল হিসেবে ফ্ল্যামিঙ্গোদের পা হয়ে গেল লাল। আছে ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ লিখে ম্যাজিক রিয়েলিজমের গুরুতে পরিণত হওয়া কালজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা এক উদ্ভট ভাগ্যাহত দেবদূত আর সমুদ্রে ভেসে আসা উটকো অথচ অপূর্ব রূপবান কোনো এক ‘এস্তেবান’-এর গল্প। অন্য গল্পগুলির মধ্যে আছে পাবলো নেরুদার লেখা আত্মজীবনীর কিছুটা অংশ, যাতে উঠে এসেছে চিলির ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’-এর জীবন, প্যারাগুয়ের এক বেওয়ারিশ বাচ্চা, এক মুরগির গল্প, এক রাজা আর ভাগ্যাহত কবি, একটি গাছের গল্প, সামরিক জান্তার চাতুরীকে হার মানিয়ে দেওয়া ক্ষুদে সেই বালক, মুরগির জন্য এক রেড ইন্ডিয়ানের দরদ কিংবা নলখাগড়াদের ফাঁপা হয়ে যাওয়ার রহস্য। প্রতিটি গল্পই বিষয়বৈচিত্র্যে স্বতন্ত্র। লাতিন এই গল্পগুলিতে আপাত ঘটনা পরম্পরার পাশাপাশি ফুটে উঠেছে গভীর জীবনবোধ আর দর্শনের কথাও, যাতে ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও পাবেন চিন্তার নানা খোরাক।
৮৮ পৃষ্ঠার বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে রফিকুন নবীর আঁকা ছবিগুলি। বহুদূরের এক অজানা ভূখণ্ডকে পাঠকের হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চমৎকার মাধ্যম হিসেবে সংকলনটি বিবেচনার দাবি রাখে।