
সুতীর্থ: মূলানুগ পাঠ
সুতীর্থ: মূলানুগ পাঠ। এই উপন্যাসটি মূল পাণ্ডুলিপি অনুসারে সম্পাদনা করেছেন ভূমেন্দ্র গুহ। বইটির শেষে প্রায় অর্ধেক বইজুড়ে উপন্যাসে উল্লিখিত নানা শব্দ বিষয়, প্রসঙ্গগুলিকে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। যার কারণে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আরো সমৃদ্ধ।বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী রফিকুন নবী।
উপন্যাসটির শুরুতে দেখা যায় সুতীর্থ একজন কবি, কিন্তু ইদানীং তার আর লেখা-লেখি হচ্ছে না। পেশাগত জীবনের চাপে, সময়ের অভাবে লেখা ছেড়েই দিয়েছে সে। পড়ে মনে হতে পারে, জীবনানন্দ তাঁর নিজের কর্মজীবন কিংবা বেকার জীবনের যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়ে লিখতে পারছেন না সেই অনুভব থেকে শুরু করেছেন উপন্যাসটি। অবশ্য কয়েক পাতা পড়ার পর বোঝা যায়, এটি আত্মজৈবনিক নয়। আরো পরে গিয়ে জানা যায়, পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্য করা কিংবা সশস্ত্র বিপ্লবে দীক্ষা নেয়ার কাজও সুতীর্থ করেছে। আবার জানা যায়, রিভলভার কিংবা উচ্চশিক্ষা কোনোটাতেই বিশ্বাস ছিল না সুতীর্থের।
এর মধ্যে সুতীর্থর খেয়ালিপনা পাঠককে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয় কখনো-সখনো। যেমন, কোনো কারণহীনভাবে সে সবাইকে বলে বেড়ায় যে, পাশ গাঁয়ে তার স্ত্রী-সন্তান থাকে, অথচ সে বিবাহিত নয়। এমনকি পাশ গাঁ বলে কোনো জায়গার অস্তিত্বই নেই। অসুস্থ স্বামী নিয়ে তার বাড়িওয়ালি মণিকা চরিত্রের সমাবেশ; বেখেয়ালি সুতীর্থর প্রতি অগতায়ুযৌবনা মণিকার খুব সূক্ষ্ম অনুরাগ এবং মণিকার প্রতিও সুতীর্থর আকর্ষণ ইত্যাদির অনুপানে উপন্যাসটি এগিয়ে যেতে পারত একটা যৌক্তিক রেখাপথে। মণিকার অর্থের প্রয়োজন, ঘরে অসুস্থ স্বামী, তবু আরো বেশি টাকায় ভাড়া দেয়া সম্ভব হলেও মাসের পর মাস ভাড়া বাকি রাখা সুতীর্থকে সামান্য ভাড়ায় তাদের বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে থাকতে দেয় ও, সুতীর্থ দেরি করে ঘরে ফিরলে তার জন্য অধীর হয়ে বসে থাকে, আবার বিরূপাক্ষ যখন টাকার জোরে মণিকাকে দখল করতে চায় সেজন্য ঈর্ষা করে সুতীর্থ। অন্যদিকে মাধ্যমিক স্কুল না ডিঙানো, ঠিকাদারি, মজুতদারি, শেয়ারবাজারিসহ নানান ব্যবসায় প্রচুর অর্থ অর্জনকারী বিরূপাক্ষও উপন্যাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যে নমঃশূদ্র হয়েও কেবল অর্থের জোরে বিয়ে করতে সমর্থ হয়েছে মনোবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষিতা সুন্দরী বামুন ঘরের মেয়ে জয়তীকে। জয়তী কেবল অর্থের লোভেই বিয়ে করেছে বিরূপাক্ষকে, এমনকি সে যখন স্বামীর সাথে শয্যা আলাদা করে ফেলে।
জয়তী ও সুতীথর্র মধ্যে একসময় যে অনুরাগের সম্পর্ক ছিল, সে কথা বিরূপাক্ষ জানে। আরেক চরিত্র জয়তীর স্তাবক ও প্রেমিক অবিবাহিত সচ্ছল ক্ষেমেশ চৌধুরী। সুতীর্থের খোঁজে এসে বিরূপাক্ষ মণিকাকে দেখে মুগ্ধ হয়। তার টাকা আছে বলে সুতীর্থের বাকি পড়া বাড়ি ভাড়ার চেয়ে বেশি মিটিয়ে দিয়ে মণিকাকে পেতে চায়। সন্ধ্যার পর সে বাড়িতে হানা দেয় যখন-তখন। মণিকার প্রয়োজনের কাছে সেই টাকা গ্রহণের দ্বিধা হার মানে বলে মণিকার আচরণেও থাকে স্পষ্ট প্রশ্রয়।
উপন্যাসের কাহিনি একসময় একটা দার্শনিক গন্তব্য খুঁজে পায় যেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর দর্শনের সপক্ষে কাজ করার জন্য সুতীর্থকে সহিংস আন্দোলন এবং নাগরিক যান্ত্রিক জীবন থেকে গ্রামের সহজ-সরল পরিবেশে পাঠিয়ে দেন, যেন সেটিই ছিল সুতীর্থের চূড়ান্ত তীর্থ।
পরিশেষে বলা যায়, যেহেতু ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত ‘সুতীর্থ’ উপন্যাসের এই বেঙ্গল পাবলিবেশনস সংস্করণটি মূল পাণ্ডুলিপি অনুসারে মূলানুগ পাঠের মধ্য দিয়ে গ্রন্থিত হয়েছে, সেহেতু এটিকে আমরা সর্বশেষ নির্ভুল গ্রন্থ বলতে পারি।