
ঠিকানা
ইতিহাস আর গল্পের মধ্যে তফাত হলো অভিজ্ঞতা আর তথ্য। গবেষণার মাধ্যমে তথ্যভারাক্রান্ত ইতিহাস সব পাঠকের জন্য সহজপাঠ্য নয়। গল্পের আদলে ইতিহাস উপস্থাপন করলে তা খটমট তথ্যের বদলে হয়ে ওঠে কাহিনি, ইতিহাসের কাহিনি। ‘ঠিকানা’ বইটি তাই গল্পেরও নয়, ইতিহাসেরও নয়। সৈয়দা জাহানারার এ বইটি তাই ছেঁড়া খাতার পাতা জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা একটি আখ্যান।
এটি কোনো গল্প নয়, কাহিনিও নয়। লেখকের জীবনে বারবার ঠিকানা হারিয়ে ফেলার অনুভূতি। এর মধ্যে আনন্দ-বেদনা আর আশা-নিরাশার কথকতা একাকার হয়ে আছে। প্রথম দেখায় মনে হয় লেখক বলেছেন শুধু নিজের গল্প। কিন্তু পাঠ শেষে পাঠকের উপলব্ধি হয় যেন ইতিহাসের এক লম্বা অধ্যায় পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে। ইতিহাসের অনেক ঝড়ঝঞ্ঝার সাক্ষী সৈয়দা জাহানারা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, পূর্ব বাংলায় গণতাতিন্ত্রক আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সে সময়ে ভারতে শরণার্থী জীবন, যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন ও অস্থিরতা এ সমস্ত কিছুর ভেতর দিয়ে জীবন পার করেছেন তিনি। যেমন বৃহত্তর পারিবারিক আবেষ্টনীতে, তেমনি এই সামাজিক উত্থান-পতনে লেখক নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। শৈশব, যৌবন হারানো এক সংগ্রামী জীবন পার করে তারই সংক্ষিপ্ত রূপ সরল গদ্যে তুলে ধরেছেন লেখক আমাদের সামনে। লেখকের বয়ানে এক সংগ্রামী নারী জীবনের চিত্র দেখতে পাই আমরা। ইতিহাসের বিশেষ স্থানকাল ও নারী জীবনের চিরন্তনতা ধরা পড়েছে এ বইয়ে।
লেখকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে, শৈশব সেখানেই। তবে বাবার কর্মসূত্রে কিছুকাল পরেই চলে আসেন এপার বাংলায়, খুলনায়। পড়াশোনা শেষ না হতেই বিবাহসূত্রে চলে আসেন দিনাজপুরে। বয়স কুড়ি না হতেই দায়িত্ব নিতে হয় সংসারের। এর মাঝেই তিনি শেষ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, করেছেন সন্তানপালন এবং শিক্ষকতা। অবসরের পরেও বেসরকারি সাহায্য সংস্থায় যোগ দিয়ে কাজ করেছেন অসহায় নারীদের জন্য। এসব সামলে নিয়মিত লিখেছেন বেশকিছু কাগজের জন্য। নিতান্ত ব্যস্ততায় কেটেছে লেখকের জীবন। তাই সময় এবং ঘটনার বর্ণনায় বাস্তবতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ বইয়ে। ‘ঠিকানা’ তাই ব্যক্তির ভাষণে এক লম্বা সময়ের যাত্রাকে ধারণ করে যার গল্প বারবার আপন ঠিকানা পরিবর্তন করে খুঁজে ফেরে নতুন ঠিকানা।