
বিল্টু মামার আরেক কান্ড
কাইজার চৌধুরী চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু লেখালেখি করলেও তাঁর মূল পরিচয় শিশুসাহিত্যিক হিসেবে। বাংলাদেশের সমকালীন শিশু ও কিশোর সাহিত্য যে কয়জন লেখকের লেখনীতে পুষ্ট হয়েছে তাদের মধ্যে কাইজার চৌধুরীর নাম বিলক্ষণ উল্লেখযোগ্য। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু নামিদামি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখক তাঁর ‘বিল্টুমামার আরেক কান্ড’ নামক গল্পগ্রন্থে কিশোরদের জন্য আনন্দময় বাস্তবতা, সামাজিক নানা সমস্যা, দুর্নীতি, সায়েন্স ফিকশন এবং অতি অবশ্যই কাইজার চৌধুরীর প্রিয় বিষয়, কিছুটা আধিভৌতিকতার মিশ্রণ করেছেন।
‘বিল্টুমামার আরেক কাণ্ড’ মূলত ছয়টি ছোটগল্পের একটি সংকলন। তাঁর বিখ্যাত গোয়েন্দা কিংবা ‘হতে পারতো গোয়েন্দা’ বিল্টুমামা, পুলিশ অফিসার পল্টুমামা, তার ভাগ্নে ছোটলু এবং আরেকটি মজার চরিত্র ন্যাড়ার উপস্থিতি প্রায় প্রত্যেকটা গল্পেই দেখা যায়। কাইজার চৌধুরীর নায়কদের মত অপরাধীরাও বেকায়দা-বেফাঁস কাজ করতে সিদ্ধহস্ত আর তাদের এই হরেকরকমের মজার কর্মকাণ্ডই উঠে এসেছে বইটির গল্পগুলিতে।
গল্পগুলি শিক্ষামূলক, কিন্তু তাই বলে একঘেয়ে বা নিরস বলা চলবে না কোনোমতেই। এখানে বারবার উঠে এসেছে আমাদের সমাজের চিরন্তন সমস্যা : অপহরণ, পকেট কাটাসহ অন্যান্য অপরাধ। ‘ন্যাড়ার মুকিতকাকু’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা, আর ব্যতিক্রমী গল্প হিসেবে আছে ‘ন্যাড়ার লিটনকাকু’ যেটা কিনা একটি পুরোদস্তুর সায়েন্স ফিকশন। অন্য গল্পগুলি হচ্ছে : ‘অবাক করলো বিল্টুমামা’ যেখানে আনাড়ি গোয়েন্দা আসলেই নিজের খেল দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়; ‘দুরমুজ দারোগা বনাম গাঁটকাটা মনা’ যেখানে হিতৈষী দারোগার পরোপকার সব থেকে দাগী লোকটিরও জীবন পালটে দেয়; ‘গল্পটি কিন্তু প্যাচালোতে আছে’ এক অপহরণকারীর কথা যে আবার কিছুটা হলেও মানবতা বজায় রাখতে পেরেছে, অপহৃতদের সে দিব্যি খাইয়ে পরিয়ে রাখে আর ‘বিল্টুমামার আরেক কাণ্ড’ যেখানে শখের গোয়েন্দা পুনরায় সমাধান করে একটি দুর্দান্ত কেসের। কাকতালীয় ঘটনার উপস্থিতি কাইজার চৌধুরীর শিশুতোষ গল্পগুলিতে নিত্য দেখা যায়, এই গ্রন্থের গল্পগুলিও এর ব্যতিক্রম নয়।
কাইজার চৌধুরীর লেখা সরল, সাবলীল। কিছুটা শিব্রামীয় স্টাইল অনুসরণ করলেও বিন্যাস কাঠামোর দিক দিয়ে গল্পগুলি যথেষ্ট স্বতন্ত্র। গল্পে জটিল ও কিছুটা অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার, শব্দচয়নে, বাক্যগঠনে, কথোপকথনের হাস্যরসাত্মক স্টাইল আর সেই সাথে হঠাৎ ক্লাইম্যাক্স গল্পগুলিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে বহুগুণে। কিশোরদের কল্পনাজগৎকে উসকে দিতে, সেই জগতের চাহিদা মেটাতে অথবা অন্তত নির্মল বিনোদনের খোরাক জোগাতে এই গল্পগুলি সফল হবে বললে ভুল বলা হবে না।
*** অমর্ত্য গালিব চৌধুরী
কাইজার চৌধুরী আমাদের কিশোরগল্পের ভুবনের এক আশ্চর্য গল্পশিল্পী। অসাধারণ এক গদ্যরীতি অধিগত তাঁর; শব্দচয়নে, বাক্যগঠনে, সর্বোপরি গল্পকথনে তিনি ছড়িয়ে দিতে পারেন অপরূপ এক জাদু; তুলনারহিত সেই জাদুর আকর্ষণে মোহগ্রস্ত না হয়ে উপায় নেই। ছয়টি গল্প নিয়ে তৈরি করা তাঁর এই বইটিও অনিবার্যভাবে আমাদের একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে দেবে। এখানে একদিকে আছে অপরাধজগতের বাসিন্দাদের নিয়ে সামাজিক টানাপড়েন, অন্যদিকে নির্মল হাসি ও আনন্দদায়ক কিছু চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে সুন্দর সমাজব্যবস্থা নির্মাণের স্বপ্নের কথা। আর বিখ্যাত চরিত্র বিল্টুমামার অপরিবর্তনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এক অনবদ্য আয়োজন বিল্টুমামার আরেক কাণ্ড।