
ভুতুড়ে ডাকাত বনাম হাড়কিপটে বুড়ো
বাংলাদেশের সমকালীন শিশু ও কিশোর সাহিত্য যে কয়জন লেখকের লেখনীতে পুষ্ট হয়েছে তাঁদের মধ্যে কাইজার চৌধুরীর নাম বিলক্ষণ উল্লেখযোগ্য। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু নামিদামি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখক তাঁর ‘ভুতুড়ে ডাক্তার ও হাড়কিপটে বুড়ো’ নামক গল্পগ্রন্থে কিশোরদের জন্য আনন্দময় বাস্তবতা এবং রহস্যঘেরা জগতের এক অনুপম গাথা রচনা করেছেন।
‘ভুতুড়ে ডাকাত এবং হাড়কিপটে বুড়ো’ মূলত সাতটি ছোটগল্পের সংকলন। শেষোক্ত গল্পটির নামেই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে ‘আধখানা ভূতের গল্প’, ‘ছেলেটি’, ‘জমানো টাকার ইতিবৃত্ত’, ‘একটি নিছক ভূতের গল্প’, ‘হারানো প্রাপ্তি’ এবং ‘ন্যাড়ার লোচনকাকু’। কাইজার চৌধুরীর বিখ্যাত সৃষ্টি ন্যাড়া আর ছোটলু অবধারিতভাবে বেশিরভাগ গল্পেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্থান পেয়েছে।
কাইজার চৌধুরী নেহাত শিশুতোষ গল্পগুচ্ছ রচনা করেননি এখানে, সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন শিক্ষণীয় বহু উপাদান। গল্পগুলিতে বারবার এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা দুঃখী, দুস্থ মানুষকে সাহায্য করার মতো মানবিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি। ভূত, অশরীরী এবং মানুষ অর্থাৎ কায়া, ছায়া ও মায়ার ঠাসবুনটে লেখা গল্পগুলি শিশুসাহিত্যের মানদণ্ডে নিঃসন্দেহে উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে। আধুনিক সংকটগুলিও লেখক ভুলে যাননি। একটি গল্পে ব্যাংকের বিপুল অর্থপাচার আর অপরাধীদের দিকে নির্দেশ করে লেখক আভাস দিয়েছেন আমাদের বিদ্যমান সমাজের গভীর ত্রুটিগুলোর দিকে। শিশু-কিশোরদের সচেতনতার দিকেও সতর্ক এই নজর গল্পগুলিকে আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
কাইজার চৌধুরীর লেখা সরল, সাবলীল। কিছুটা শিব্রামীয় স্টাইল অনুসরণ করলেও বিন্যাস কাঠামোর দিক দিয়ে গল্পগুলি যথেষ্টই স্বতন্ত্র। গল্পে জটিল ও কিছুটা অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার, শব্দচয়নে, বাক্যগঠনে, কথোপকথনের হাস্যরসাত্মক স্টাইল আর সেই সাথে ক্লাইম্যাক্স গল্পগুলিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। যেমন ‘হাড়কিপটে বুড়ো’ গল্পের শেষ অংশটুকু দিয়েই তিনি গল্পে এমন এক ইতি টানেন, যার কথা হয়তো কিশোর পাঠকের চিন্তাতেও আসবে না। কিংবা ধরা যাক ওই লোকটির কথা, যে বিপুল বিত্তবৈভব অসাধু উপায়ে অর্জন করবার পর হঠাৎ নিজের ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা বড়ভাইয়ের দেখা পায় এক রহস্যময় পরিবেশে। কিশোরদের কল্পনাজগৎকে উসকে দিতে বা সেই জগতের চাহিদা মেটাতে গল্পগুলি সফল হবে বললে ভুল বলা হবে না।বাংলাদেশের শিশু ও কিশোর সাহিত্য যে ক’জন সাহিত্যিকের হাতে সাবালক হয়েছে কাইজার চৌধুরী তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর লেখনীতে কিশোরদের মনোজগৎ ও ভুবন বাস্তবতার অনুষঙ্গে নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। শুধু রহস্যঘেরা জগৎ নয়, বাস্তবতা এক আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠেছে। কাইজারের কিশোরদের জন্য নানা লেখায় এই বোধ ছড়িয়ে আছে।