
যুদ্ধ ও আমি
২৬ মার্চ। তখনো অন্ধকার। সূর্য ওঠার অনেক দেরি। দুমাসের শিশুর পাশে ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ কানে এলো, পুরুষের ভাঙা কণ্ঠস্বরে কারা যেন বাড়ির সামনের বড় রাস্তা দিয়ে মাইকে কিছু জানিয়ে যাচ্ছে। কী? নিশ্চয় বড় কোনো সংবাদ। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে ‘সাহিত্য নিকেতনে’র সামনের বারান্দায় ছুটে গেলাম। বাবা আবুল ফজল দাঁড়িয়ে দেখছেন ও শুনছেন দশ-বারোজন শ্রমিকের মতো মানুষের মুখে অমোঘ সেই ঘোষণা ‘…শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন…!’ হালকা কুয়াশার চাদরে ওদের অশরীরী মনে হচ্ছিল। সর্ব দেহ-মনে এক শিহরণ অনুভব করলাম। বাবা বললেন, ‘জহুর আহমদ চৌধুরীর লোক। তিনি কোনোভাবে খবর পেয়েছেন নিশ্চয়। তাঁর লোকদের দিয়ে আমাদের জানিয়ে দিলেন। তোর শরীর এখনো দুর্বল, শেষ রাতের বাতাসে ঠান্ডা লেগে যাবে, যা ভেতরে।’
বাবা-মেয়ের কথোপকথনে এভাবে মমতাজ লতিফের ‘যুদ্ধ ও আমি’ গ্রন্থটির শুরু। একশো আটাশ পৃষ্ঠার বইটির প্রতিটি পরতে পাঠক পাবেন যুদ্ধদিনের কথা। সে-সময় মানুষের ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবনের ভয়াবহতাও ফুটে উঠেছে সাবলীলভাবে। লেখকের বাবা আবুল ফজল কীভাবে সন্তানদের, তাঁর অনুজদের যুদ্ধদিনে দিয়েছেন নিরাপত্তার ছাতা এ-বইয়ে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে।
তবে এবার আমরা একটু না-হয় জেনে নিই বিখ্যাত এই বাবার কন্যা যুদ্ধ ও আমি বইটির লেখক মমতাজ লতিফের কথা। মমতাজ লতিফ ১৯৪৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং পরে পেশাগত উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেন এডিনবরা থেকে। মমতাজ লতিফ প্রধানত রাজনৈতিক কলাম-লেখক হিসেবে পরিচিত। গবেষণা করেছেন শিশুর বিকাশে মা-বাবা-শিক্ষকের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা বিষয়ে। ছাত্রজীবনে ছাত্ররাজনীতিতে গভীর আন্তরিকতা নিয়ে একটি স্বাধীন মাতৃভূমির স্বপ্নের লক্ষ্যে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন নেতা হিসেবে নয়, কর্মী হিসেবে। ওই স্বপ্নপূরণে একদিন যখন শত-শত, হাজার-হাজার, লাখ-লাখ তরুণ-তরুণী একাত্তরের যুদ্ধযাত্রায় শামিল হলেন, তখন তিনি অসহায় হয়ে দেখলেন দুই শিশু তাকে ওই স্বপ্নযাত্রার পথ রোধ করে দাঁড়াল! সূর্য সেন, চে গুয়েভারা যাঁর স্বপ্নপুরুষ, তিনি একা একালের চে গুয়েভারাদের সঙ্গে রাইফেল-হাতে যোগ দিতে পারলেন না, হয়ে থাকলেন অ-মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে শুরু হয়ে শেষ হতে দেখেছেন, যা তিনি তাঁর জন্য দুর্লভ সৌভাগ্য হিসেবে গণ্য করেন। কেমন ছিল তাঁর শিশুসন্তান, ভাই, মা-বাবা, শিক্ষক, আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে একত্রে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রায় জীবনের অদেখা বদ্ধ দুয়ার? নানা দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে জীবনের মহৎ, শুভ-অশুভ চেহারাকে দেখার আনন্দ-বেদনার অভিজ্ঞতা, তা পাঠককে জানানোর এক দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছা পূরণ করতে তিনি লিখেছেন এ-বই। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবরুদ্ধ ছিলেন তিনি। সে-সময়ের যে-যুদ্ধদৃশ্য অবলোকন করেছেন, শুনেছেন তারই বিশদ বর্ণনা যুদ্ধ ও আমি।