
নিঃশব্দতার ভাঙচুর
‘দরজার ফাঁক দিয়ে রাবেয়া দেখলো থরে থরে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। সিঁড়ির ধাপগুলো পুরনো দিনের হলেও কী মসৃণ লাল সিমেন্টে বাঁধানো। দু’দিকে কালো বর্ডার। ঘরের আলোয় চিকচিক করছে চাতাল। শীতলতার একটা দূরত্বে ধাপগুলো স্থির হয়ে আছে, যেন তারাও এক ধরনের রুদ্ধশ্বাস। কে ওখানে, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য যেনো তারাও উৎকীর্ণ হয়ে আছে।’
একটা শহরে হাজারো বিচ্ছিন্ন মানুষ । বৈষম্য-কলঙ্কিত সমাজের যে খাদ্য-শৃঙ্খল, সামনে এগোনোর যে ইঁদুর দৌড়, তার একজন রাবেয়া। রাবেয়া এক মধ্যবয়সী নারী। জীবন তাকে যা দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে তার শতগুণ বেশি। শোক, স্মৃতি আর সংগ্রাম নিয়ে রাবেয়ার বেঁচে থাকার আলেখ্য ‘নিঃশব্দতার ভাঙচুর’। এ এক ব্যতিক্রমধর্মী সামাজিক উপন্যাস। আনোয়ারা সৈয়দ হক এক নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাত্যহিক জীবন দেখার সুযোগ করে দেন পাঠককে, সুযোগ দেন পদে পদে ধর্ষণ, লাঞ্ছনা, লালসা আর হয়রানির আতঙ্ক কাটিয়ে চলা বাঙালি নারীর জীবন উপলব্ধি করার। এই জীবনে খোকনের বেঁচে থাকার সুযোগ নেই, এই জীবনে নেই রাবেয়ার মানসিক সুস্থতা ও শান্তি। মনোবিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞান তো আনোয়ারা সৈয়দ হক কাজে লাগিয়েছেনই, আরো উল্লেখযোগ্য দিক হলো – এই উপন্যাসে নিছক ঘটনাপ্রবাহ নয়, লেখিকা প্রয়াস পেয়েছেন চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের ভেতরে যে ছাপ রেখে যায়, সেটা তুলে আনার। ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’ বা ‘চৈতন্য প্রবাহরীতি’ ব্যবহার করার কারণে রাবেয়ার খণ্ড ভাবনাগুলো উঠে এসেছে কেন্দ্রে, আর পাঠক পেয়েছে তাকে বোঝার গভীরতর সুযোগ।
আনোয়ারা সৈয়দা হক পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক। জন্ম ১৯৪০ সালে, যশোর জেলায়। মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে আসেন তিনি, তখনই মনোযোগ দেন লেখালেখিতে। বর্তমানে ঢাকার বারডেম হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের প্রভাষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা একশরও বেশি। মননশীল সাহিত্য রচনার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিণী। লেখালেখির ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানো তাঁর সৃষ্টিকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।