
আপনি তুমি রইলে দূরে
রফিক কায়সারের নবতম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আপনি তুমি রইলে দূরে’তে গ্রন্থিত হয়েছে মোট সাতটি প্রবন্ধ। কোনোটি আকারে দীর্ঘ, কোনোটি ক্ষুদ্র এবং সব লেখাতেই ভিন্নতাবাহী দৃষ্টিকোণে আলোচিত হয়েছে অতীত ও বর্তমানের কয়েকজন বাঙালি-মনীষার রচনাকর্ম-জীবনচর্যা আর একাধিক গ্রন্থ। প্রথম তথা নামপ্রবন্ধ ‘আপনি তুমি রইলে দূরে’র পটভূমিতে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ-পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত রথীন্দ্রনাথের লেখা চিঠির একটি সংকলনকে অবলম্বন করে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েন ও তাঁকে ঘিরে সৃষ্ট নানামুখী বিতর্ককে এখানে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন লেখক। তাঁর মতে, পারিবারিক বাস্তবতা রথীন্দ্রনাথকে আপন সত্তার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেনি, বরং কবিপুত্রের পরিচয়ই তাঁকে আমূল গ্রাস করেছিল।
ব্যক্তিগত মতের চাইতে জীবনে পিতার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি, নিজের মতামত জানানোর সুযোগ সেভাবে পাননি। নিজের লেখালেখির তাই সূচনা কবির মৃত্যুর পর। আবার পিতারই নির্দেশে তাঁর পছন্দের পাত্রীর পাণিগ্রহণ করতে হয়েছে। ফলে কবি-প্রয়াণের পর দম্পতির পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল শৈত্যপ্রবাহ তথা এক অমোচনীয় দূরত্ব। সেই দূরত্ব পূরণ করেছিলেন বিশ্বভারতীর শিক্ষক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়। আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কটি নিয়ে প্রথমদিকে তেমন কিছু কেউ ভাবেননি; কিন্তু পরে রথীন্দ্রনাথের নিকটাত্মীয়রা মনে করলেন, এ-সম্পর্ক আদতে ‘নির্মল দম্পতির বৈষয়িক কোনো উদ্দেশ্য পূরণ’ করবে, তেমনি শান্তিনিকেতনের বাসিন্দাদের কাছে তা হয়ে দাঁড়াল এক বহুচর্চিত ‘কেচ্ছা’। পরে তাঁর ঘাড়ে উটকো ঝামেলা হিসেবে এসে পড়ল (সরকারের শিক্ষা দফতরের তরফ থেকে) ‘তহবিল তছরুপে’র অভিযোগ ও ‘প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা’র দায়। এসব ঘটনা ও পূর্বতন সম্পর্কের সূত্র ধরে রথীন্দ্রনাথের স্বেচ্ছায় প্রস্থান ঘটল শান্তিনিকেতন থেকে, মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে থেকে গেলেন দেরাদুনে। রফিক কায়সার মনে করেন, অব্যবস্থাপনার দায় রথীন্দ্রনাথের একার ছিল না। রবীন্দ্রনাথের আমল থেকেই তা প্রায় শান্তিনিকেতনের ‘ঐতিহ্যে’ পরিণত। রথীন্দ্রনাথ সেই অচলায়তন ভাঙতে পারতেন, কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তিনি করেননি। তবে সরকারি কর্মকর্তারা ও শান্তিনিকেতনের গুরুবাদী মানসিকতাসর্বস্ব অনেক কর্মীও তাঁর সঙ্গে নম্র-যৌক্তিক আচরণ করেননি। অপরদিকে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে সম্মান করার বদলে তা নিয়ে কুৎসা রটনাই যেন কারো-কারো নৈমিত্তিক কাজ হয়ে পড়েছিল। ফলে সামাজিক গ্লানি ও লোকলজ্জাকে সঙ্গী করেই বাকি জীবনটুকু রথীন্দ্রনাথকে কাটাতে হয়েছিল।
‘উত্তম পুরুষ’ প্রবন্ধে প্রয়াত কথাশিল্পী রশীদ করিমের প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষের অনুপুঙ্খ আলোচনালভ্য। রশীদ করিম তাঁর প্রথম উপন্যাসেই পাঠক ও লেখকের মধ্যে চরিত্র নিয়ে ভাবনার ঐক্য স্থাপনে সচেষ্ট ছিলেন। তবে উঁচু পর্দায় পাঠকের আবেগকে নাড়া দিতে গিয়ে কোনো-কোনো চরিত্রের ভারসাম্যকে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন এমনটা লেখকের ধারণা। পাঠকের মনে উৎকণ্ঠা ও সংশয় সৃষ্টি করতে গিয়ে কাহিনিগত শৃঙ্খলাও হ্রাস পেয়েছে কিনা, এ-শঙ্কার উল্লেখও তিনি করেন। তবে রশীদ করিমের গদ্যের ইতিবাচকতার মধ্যে দিয়ে তাঁর উপন্যাসের নির্মাণকৌশলের প্রতি পাঠকের আস্থাশীলতা জন্মায় এমনটাও রফিক কায়সার মনে করেন।
জীবিত অবস্থাতেই যিনি বাংলাদেশের সাহিত্যম-লে এক ‘ফেনোমেননে’পরিণত হয়েছিলেন, সেই হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য ও জীবনকে লেখক ভিন্নভাবে বিচার করেছেন ‘ফরায়েজ-এ-হুমায়ূন’ শীর্ষক দীর্ঘায়তনের প্রবন্ধটিতে। লেখক হুমায়ূনের সফলতা ও জনপ্রিয়তার নেপথ্যের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাঁর বহুমাত্রিক পরিপ্রেক্ষিত রচনার ক্ষমতাকে, ‘উক্ত পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছিল মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, বিচ্ছেদ ও বিরহ, জ্যোৎস্না ও বৃষ্টি-মাখানো ঐকতানে। যে ঐকতানে ছিল বাঙালির প্রকৃতি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার ধর্মীয় সত্তা, তার প্রাত্যহিক জীবন এবং তাদের নারী-পুরুষের সম্পর্কের টানাপড়েনের এক বিশ্বস্ত বয়ান।’
‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ : ঔপন্যাসিকের দায়ভার’ প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর উপন্যাসে ব্যক্তিমানসের স্বরূপ অন্বেষায় ব্যাপৃত হয়েছেন আত্মবিশ্লেষণের রীতিতে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের মধ্যে সাবলীলভাবে সঞ্চারিত হয় এক অনিকেতবোধ। উপন্যাসের নায়কদের মধ্যেকার ‘প্রশ্নশীলতা ও আত্মজিজ্ঞাসার প্রতিক্রিয়ায় পাঠকের মধ্যেও গড়ে উঠতে থাকে প্রতিবর্তী ভাবনা।’ ওয়ালীউল্লাহর সৃষ্ট চরিত্রদের প্রশ্নশীলতা ও অনিকেতবোধ প্রসঙ্গে রফিক কায়সার স্মরণে আনেন গত দুই শতকের ইউরোপীয় লেখকদের কথা। ‘যুদ্ধের খোঁজে’ লেখাটিতে জাহানারা ইমামের ক্ল্যাসিকসম গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ ব্যতিক্রমী ও বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। বইটির গ্রহণযোগ্যতা ও পাঠকপ্রিয়তার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে লেখক বলেছেন, প্রথমত রোজনামচার অনুষঙ্গে গল্প বলার ভঙ্গি পাঠকের কাছে একে আদরণীয় করে তুলেছে। এরপর নিজের শহীদ-পুত্র রুমীর যুদ্ধে যাওয়ার আখ্যান বলতে গিয়ে জাহানারা ইমাম যেভাবে এক পারিবারিক আবহ তৈরি করেন, তাও পাঠকদের এক আটপৌরে আবহে বসিয়ে দেয়। আর আস্তে আস্তে রুমীর যুদ্ধে যাবার আখ্যান হয়ে উঠতে থাকে এক সংগ্রামী জননীর নিজের যুদ্ধকে খুঁজে পাওয়ার বয়ানও। মোরশেদ শফিউল হাসানের বই স্বাধীনতার পটভূমিতে ষাটের দশক নিয়ে আলোচনা রয়েছে ‘ফৌজি জামানা’ শিরোনামের বৃহৎ আকৃতির রচনায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশক বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, সেই সময়কে নিয়ে রচিত বইটির আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বেশকিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য ও নিজস্ব ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, যা বইটির মূল্যায়নের উপাদান হিসেবে যেমন, তেমনি এর পাশাপাশি স্বতন্ত্র সামাজিক-রাজনৈতিক আলোচনা হিসেবেও মূল্যবান।
গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধ ‘মায়া রহিয়া গেল’ বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে কমলকুমার মজুমদারের রচনাসম্ভারের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কীরকমভাবে পড়েছে, তার একটা খতিয়ান তুলে ধরেছে। রফিক কায়সার এ-প্রবন্ধের শেষাংশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শামসুর রাহমানের চিঠি এবং আনিসুজ্জামান ও হাসান আজিজুল হকের সাক্ষাৎকারে উঠে আসা কমলকুমার-প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন।