
এবং এলিয়ট
উনিশ শতকের শুরুতে, ইউরোপ যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মত্ত, তখন দুই মার্কিন তরুণ কবির হাতে বদলে যাচ্ছিল ইংরেজি কবিতার ভাষা। তখনো পর্যন্ত রোমান্টিক আর ক্ল্যাসিসিস্ট ভাবধারার ইংরেজি কবিতার ভাষাকে তাঁরা দুঃসাহসিকভাবে ভেঙেচুরে তার স্নায়ুতে সঞ্চার করেছিলেন নতুন রক্ত। ইংরেজি কবিতাকে করে তুলেছিলেন সমকালীন বিপন্ন সময়ের সার্থক দর্পণ। এই দুই কবির মধ্যে বয়সে-আবির্ভাবে খানিকটা বড় এজরা পাউন্ড। আর অন্যজন এবং তাঁর কবিতা এই বইয়ের আলোচ্য – টি এস এলিয়ট।
টি এস এলিয়টের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’। এর আগেই অবশ্য কবিতা নিয়ে তাঁর মধ্যে ভাঙাগড়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় পার হয়ে গেছে। আর্থার সায়মনসের ‘দ্য সিম্বলিস্ট মুভমেন্ট ইন লিটারাচার’ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ফরাসি কবি জ্যুল লাফর্গের। তাঁর কাছ থেকে তিনি শিখলেন এক নতুন ঠান্ডা বাকভঙ্গি, আত্মশ্লেষ, আত্মপ্রশ্ন, নতুন ধরনের বাকপ্রতিমা ও মুক্তছন্দ। শিখলেন প্রশ্নবোধক বাক্য ও পুনরুক্তির জাদুকরি ক্ষমতা। কেবল লাফর্গই নয়, এলিয়টের ওপর সামগ্রিকভাবেই ফরাসি কবিদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তার ওপর বিশেষ প্রভাব ছিল শার্ল বোদলেয়র ও ত্রিস্তাঁ করবিয়েরেরও। এমনকি প্রথম জীবনে, প্যারিসে থাকতে তিনি ফরাসিতে কাব্যচর্চারও চেষ্টা করেছিলেন। এছাড়া সতের শতকের ইংরেজ মেটাফিজিক্যাল কবিগণ, ইতালীয় কবি দান্তে প্রমুখের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এ বাবদে তাঁর বিখ্যাত একটা উক্তিও আছে – ছোট কবিরা চুরি করে, বড় কবিরা করে অনুকরণ।
টি এস এলিয়টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে – ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’। কাব্যটি বিশ্বকবিতারই গতিপথ বদলে দেয়। এমনকি এই কাব্যটি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল বাংলা কবিতার ধারাকেও। এই কাব্যের, তথা এলিয়টের বিপুল প্রভাব পরিলক্ষিত হয় বাংলার ‘পঞ্চপা-ব’ তথা পাঁচ আধুনিক কবি, সমর সেন প্রমুখের ওপরও। জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতাকেই মনে হয় বাংলায় লেখা এলিয়টের কবিতা।
কখনোই কোনো প্রেমের কবিতা না লেখা এলিয়টের রচনার অনেক রহস্যের গ্রন্থিমোচন আজো হয়নি। তবে তাঁর রচনাগুলোর চেয়েও রহস্যঘেরা তাঁর ব্যক্তিজীবন। এই রহস্যের ঘেরাটোপের কারণ তাঁর জীবনের নানা বিপরীতমুখিনতার সংঘাত তো বটেই, সেই সঙ্গে আছে তাঁর গোপন করার প্রবণতা। ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ প্রকাশের তিন বছর পরেই তিনি ইংরেজ জাতীয়তা গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে গ্রহণ করেন ইঙ্গ-ক্যাথলিক গির্জার সদস্যপদ। অন্যদিকে আবার জোর গুজব প্রচলিত যে, তিনি ছিলেন সমকামী। এই গুজব সত্যি হলে, সেটা আবার খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের সঙ্গে ভীষণভাবে সংঘাতপূর্ণ; সেই সময়ে তো বটেই। এসব রহস্যের গ্রন্থিমোচনের পথও তিনি দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ করে রেখেছেন। ১৯২৫ সালে উইল করে এলিয়ট তাঁর জীবনী নিষিদ্ধ করে দেন। তাই তাঁর জীবনীকাররা তাঁর পরিবারের কাছ থেকে কোনো রকম সহায়তা পাননি। এমনকি তাঁর শর্তানুসারে, এমিলি হেলকে লেখা তাঁর প্রেমপত্রগুলোও ২০১৯ সালের আগে খোলা যাবে না।
সোজা বাংলায়, কবি হিসেবে এলিয়ট যেমন প্রভাবসঞ্চারী ও গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, তেমনি তাঁর ব্যক্তিজীবনও ছিল রহস্যের ঘেরাটোপে বন্দি। তবে কেবল কবি হিসেবেই যদি বিবেচনা করা হয়, যে কোনো কালিক বিবেচনাতেই তিনি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এবং সেজন্যই, কবিদের জন্য তো বটেই, কবিতাপ্রেমীদের জন্যও এলিয়টচর্চা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তেমনি সব কবিতাপ্রেমীর জন্যই এলিয়টকে নিয়ে জাহানারা পারভীনের এই গ্রন্থ – ‘এবং এলিয়ট’, যেখানে এলিয়টের ওপর আটটি ঝরঝরে প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে; এবং প্রকাশিত হয়েছে এলিয়টের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজারভেশনস’ প্রকাশের ঠিক একশ বছর পরে।