
কমলনামা
বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম লেখক কমলকুমার মজুমদার।অনেক লেখকের ভিড়ে কমলকুমারকে যেন একটু আলাদাভাবেই আবিষ্কার করা যায়। ভিড়ের মধ্যে নিঃসঙ্গ কিন্তু ঋজুভাবে দাঁড়িয়ে। কমলকুমার মানেই সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সাহিত্যজগতের উন্মোচন। তাঁর বিষয়, প্রকরণ, ভাষা এমনকি শব্দের ব্যবহার অন্যদের চেয়ে আলাদা। কোথাও কোথাও সাধারণের জন্য রয়েছে কিছুটা বন্ধুর পথের হাতছানি। কিন্তু সে-পথ পাড়ি দিতে পারলেই আছে রোমাঞ্চকর এক সাম্রাজ্যের সন্ধান। যা একান্তই কমলকুমারের। আর সেই সাম্রাজ্যকেই আবিষ্কারের পথে নেমেছিলেন কমলকুমারের অন্য এক উত্তরসূরি কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। ‘কমলনামা’ নামক এক বইয়ের মাধ্যমে কমলকুমারের সেই রোমাঞ্চকর জগৎকে যেন নিজের মতো করে খুঁজে দেখতে চেয়েছেন তিনি। পড়ার চেষ্টা করেছেন সেই স্বরকে যা একান্তই কমলকুমারের। আর প্রসঙ্গক্রমে এসেছে কমলকুমারের বর্ণিল ব্যক্তিজীবনের কিছু আলোকচ্ছটাও। ‘কমলনামা’ বইটি মূলত ১৩টি অংশে ভাগ করা। শুরুতেই ‘কমলের জীবন, কমলের সাহিত্য’, নামক অংশে দেয়া হয়েছে তাঁর এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের পরিচিতি। সেখানে কমলকুমারের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বলতে গিয়ে লেখক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর বলেন, ‘তিনি যে জীবন পার করে গেলেন, তা আসলে সমাপ্ত হবার নয়, তা যে রয়ে যাবে, তাই আমরা স্মরণ করতে চাই। সময় যত যাচ্ছে, যতই কথাসাহিত্যের নানান বাঁকবদল আমরা প্রত্যক্ষ করছি, ততই যেন কমলকুমারও আমাদের অতি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।’ লেখক এ অংশে কেবল কমলকুমারের প্রাসঙ্গিকতায় নয়, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিমুখতা, সাহিত্যের সাথে তাঁর যুক্ত হওয়া, নারীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁর অভূতপূর্ব ভাষার ব্যবহার, ধর্মের প্রতি কমলকুমারের দুর্বলতাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। কমলকুমারের গল্প এবং উপন্যাসকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণের প্রয়াসও নিয়েছেন কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। যেখানে জাহাঙ্গীর সামগ্রিকভাবে কমলের গল্প এবং উপন্যাসকে বুঝতে চেয়েছেন। ‘লীলায় দ্রোহে কমলকুমারের উপন্যাস’ নামক অংশে কমলকুমারের উপন্যাস নিয়ে বলতে গিয়ে লেখক বলেন, ‘আসলে কমলকুমারের উপন্যাস পড়া মানেই সময়, সংস্কৃতি, বোধ ইত্যাদির সঙ্গে একভাবে না একভাবে বোঝাপড়া করে নেওয়া।’ কমলের গল্প নিয়ে লেখক জাহাঙ্গীরের মত, ‘বঙ্কিমের পর ভাষা নিয়ে এত ঘোরবহুল ইমেজ কেউই ছড়াতে পারেননি।’ এরপর ‘কমলনামা’য় জাহাঙ্গীর কমলের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর ওপরও আলাদাভাবে আলো ফেলেছেন। সেখানে লেখক আলোচনা করেছেন কমলের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘শবরীমঙ্গল’, ‘পিঞ্জরে বসিয়ে শুক’ এবং ‘গোলাপ সুন্দরী’র মতো দুর্দান্ত সব উপন্যাস নিয়ে। জাহাঙ্গীরের কাছে কমলের উপন্যাস যেন মায়ার আকর। আর সেই মায়া নিয়ে জাহাঙ্গীর লিখেছেন ‘মায়ারও যে জন্মান্তর হয়’ নামক গদ্য। পরের গদ্যে কমলের ‘অনিলা স্মরণে’ উপন্যাসকে জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ানো উপন্যাস’। কমলকুমারের আরেকটি আলোচিত উপন্যাস ‘সুহাসিনীর পমেটম’ নিয়ে লেখা হয়েছে ‘সৌন্দর্য, স্বাধীনতা এবং পমেটমকথা’। যেখানে লেখক এই উপন্যাসকে আখ্যায়িত করেছেন সৌন্দর্যমুখর, স্বাধীনতাপিপাসু এবং মায়ার বচনে ভরপুর এক উপন্যাস বলে। অনেকেই ভাবেন কমলকুমার মানে কেবল ভাষা এবং ইমেজের কারসাজি। এই ধারণা যে ভুল তা কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর ‘খেলার প্রতিভা’ নামক উপন্যাসের আলোচনায়। দুর্ভিক্ষের দুর্দশা নিয়ে লেখা এই উপন্যাস নিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘তিনি জীবনকে জমিন-ধুলা-ঘাসের সঙ্গে মিশিয়ে চেখে চেখে উপস্থাপন করেন।’ সবশেষে এই বইয়ে আমরা খুঁজে পাই ‘মানবপূজারি কমলকুমার’কে। রামকৃষ্ণের সাথে কমলকুমারের যে মায়ার বন্ধন তা কমলের পাঠক মাত্রই জানেন। আর কমলপাঠের মাধ্যমেই রামকৃষ্ণের লোকায়ত জীবনকেও স্পর্শ করেছেন লেখক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর।