
রবীন্দ্রনাথ: কালি ও কলমে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতজন্মবর্ষ উপলক্ষে সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ প্রকাশ করেছিল দুইটি বিশেষ সংখ্যা। ‘রবীন্দ্রনাথ : কালি ও কলমে’ গ্রন্থটি সেই দুই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রকাশিত লেখাগুলির একটি সংকলন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন স্বীকৃত পলিম্যাথ, সোজা বাংলায় সব্যসাচী। গল্পকার, কবি, নাট্যকার, গীতিকার; তাঁর পরিচয় অসংখ্য, কর্মক্ষেত্র ব্যাপক ও বিরাট। কাজেই তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত লেখার মোট কলেবর যে বিপুল হবে এতে সন্দেহের অবকাশ কোথায়! মোট ৩৫টি লেখার সংকুলান হয়েছে এই গ্রন্থে। মানে গুণে তারা প্রত্যেকেই আলাদা বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে, কেননা প্রতিটি লেখাই কবিগুরু প্রসঙ্গে অবতারণা করেছে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রসঙ্গ।
বিষয়বৈচিত্র্যের নিরিখে সংকলনটি ব্যাপক। পূর্ব বাংলার অজর অচল গ্রামগুলির সাথে যোগাযোগ ঘটলে পরে সংবেদনশীল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাজগতে কি আলোড়ন ঘটেছিল সে সম্পর্কে স্পষ্ট চিত্র রয়েছে এ-গ্রন্থে। দুস্থ গ্রামের উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা এখানে আছে বিশদ কলেবরে। এরপরে আসা যাক তাঁর নাট্যকর্মে। মিলনান্ত হলেও বিশ্বকবির নাটকে দ্বন্দ্বের জায়গাটি প্রকট। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তা চিত্রিত করেছেন বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক নাটকের রেফারেন্স দিয়ে। অজ্ঞেয়বাদী স্পিনোজা, আইনস্টাইনের ঈশ্বর ভাবনা এবং রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ভাবনা নিয়ে আলোচনার অবতারণা করেছেন হারুন অর রশীদ।উঠে এসেছে নাট্যকাব্য চিত্রাঙ্গদার কথা, নৃত্যকলার সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক, পূর্ববঙ্গের সাথে কবিগুরুর সম্পর্ক, পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র-চেতনার ওপরে আঘাত, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবির অবস্থান, ষাটের দশকে রবীন্দ্রচর্চার জন্য সংগ্রামের সাথে সাথে সত্তরের দশকে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নের কথা। গান ও কবিতা এবং সৌন্দর্যবোধের প্রতি তাঁর সূক্ষ্ম দৃষ্টি, বিলেতে বাঙালিদের বিস্ময়কর হীনমন্যতা, রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র বিশেষ করে রাশিয়ার চিঠি, শান্তিনিকেতনের কর্মসাধনা, রবীন্দ্রনাথের অনুবাদকর্ম, স্বদেশি আন্দোলন নিয়ে তাঁর মনোভাব এবং অনুমিতভাবেই এসে পড়া ‘গোরা’ উপন্যাসের ব্যবচ্ছেদ। জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর ভাবনা, ঘোর ন্যাশনালিজমের বিপক্ষে থেকে বহুত্ববাদী ভারতের আপন নিজস্ব ন্যাশনালিজমের প্রতি তাঁর সমর্থন প্রভৃতি নিয়ে আছে নানাবিধ লেখা। অন্তত দুটি প্রসঙ্গ না বললেই নয়, যে কর্মটি দিয়ে তিনি প্রথম অ-ইউরোপীয় হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেন (১৯১৩) সেই ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে আছে সুখপাঠ্য একটি লেখা। আর অবশ্যই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে আজকের বাংলাদেশে তাঁর অবস্থান এবং বাঙালি মুসলমানের মানসপটে তাঁকে নিয়ে যে চিরন্তন সমস্যা, সে বিষয়টি। অর্থাৎ দ্বিধা ও ভক্তির যে নিরন্তর সংঘাত বাঙালি মুসলমান রবীন্দ্রনাথের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে অনেক সময়েই অনুভব করে, তা নিয়ে যুক্তিপূর্ণ কিছু লেখা।
সংকলনটি সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ম ও ভাবনার বিরাট ব্যাপ্তির সাথে আগ্রহী পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি প্রয়াসবিশেষ। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের সাথে পরিচিত হতে হলে তার বিপুল কর্মের সাথে পরিচিত হতে হবে, এই সংকলনটি সেই এক সাগর জল সেচে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গের অবতারণা করার মাধ্যমে আগ্রহীদের কৌতূহল মেটাতে সহায়তা করবে।