বেঙ্গল পাবলিকেশন্‌‌স

জাপানি উপন্যাস: মুরাসাকি থেকে মুরাকামি

Price
370 BDT

Published on
December 2017

ISBN
9789849302445

Category


২০১৩ সালে আমার জাপানে যাবার সুযোগ হয়। সরকারি কাজে জাইকার ব্যবস্থাপনায় প্রায় দুই মাস জাপানে অবস্থান করি। অবস্থানকালে সরকারি কাজের পাশাপাশি জাপানকে বুঝবার চেষ্টা করি। জাপানকে বুঝবার জন্য আমার কাছে পথ ছিল দুটি¬ Ñ একটি সংস্কৃতি এবং অন্যটি সাহিত্য। তবে ব্যক্তিগত অনুরাগের কারণে জাপানি সাহিত্যের প্রতিই ঝোঁক ছিল বেশি। সে পথের কিন্তু শেষ নেই। তাই জাপানকে বুঝতে পেরেছি Ñ এ কথা বলা যাবে না।
জাপানে যাবার দ্বিতীয় দিনেই কানসাই প্রিফেকচারের সান্নুমিয়া (তৃতীয় রাজকন্যা) শহরে জাপানের ঐতিহ্যবাহী এক বর্ণিল শোভাযাত্রা উপভোগ করি Ñ যদিও আমার এক সহকর্মী সে সময় হারিয়ে যাওয়ায় খুব চিন্তার মধ্যে ছিলাম। শোভাযাত্রাটি শুধু বর্ণিলই নয়, নানা উপাচারসহযোগে সাধারণ মানুষের অতিসাধারণ জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে সম্রাট-সম্রাজ্ঞী, প্রিন্স-প্রিন্সেস, কল্পিত পৌরাণিক দেবদেবী, সামুরাই তরবারিধারী, ‘বুশিদো’ ভাবাদর্শের যোদ্ধা প্রভৃতি সেজে জাপানের অতীত-বর্তমানকে একাকার করে দিয়েছিল। লোকে-লোকারণ্য ছিল সে শোভাযাত্রা। বুঝতে অসুবিধে হয়নি এ শোভাযাত্রায় জাপানের প্রাণের আবেগ সঞ্চারিত হয়েছিল। লোকঐতিহ্যের ধারা এটি। এরকম বহুলোক-উৎসব জাপানে প্রচলিত আছে। তবে বাইরের দুনিয়ায় এসব লোকউৎসব ও ঐতিহ্যের পরিচয় কমই পৌঁছে। জাপানি সংস্কৃতির যেসব দিক জাপানের বাইরেও বহুল আলোচিত সেগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদের শান্ত-বিনয়ী ব্যবহার, পোশাক-আশাক, বাড়িঘর, খাবার-দাবার, ফুল সাজাবার রীতি পদ্ধতি (ইকেবানা), ঐতিহ্যবাহী নো-কাবুকি-বুনরাকু নাটক, সুমোকুস্তি, চা-উৎসব, ক্যালিগ্রাফি, উকিও Ñ এ ছবি আঁকা প্রভৃতি। আধুনিককালের জাপান তার এসব ঐতিহ্যিক কৃষ্টি ধারণ করেও দারুণ এক শক্তিতে অবলীলাক্রমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে হজম করে নিয়েছে। বিশ্বায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে জাপানিদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের পরাজয় অবশ্য তার একটি বড় কারণ। জাপানিরা এখন পাশ্চাত্য ধাঁচের পোশাক পরিধান করে, ম্যাকডোনাল্ডসের হামবার্গার খায়, স্যুপ, রোস্ট, বিফস্টেক খাবার পর ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক অথবা ফরাসি স্যুফলে কিংবা ব্রিটিশ ইয়র্কশায়ার পুডিং গ্রহণ করে। কাঠির পরিবর্তে চামচ ব্যবহার-সংস্কৃতি কোথাও কোথাও প্রাধান্য পাচ্ছে। ফুটবল, বেসবল, টেনিস এখন জনপ্রিয় খেলা। পপ-রক-র‌্যাপ-হিপ-হপ সংগীত জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। পাশ্চাত্য চিন্তাধারা নাটক-নোবেল-কবিতার আঙ্গিক-ভাবনায় শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। ঐতিহ্যবাহী আবাসগৃহের স্থলে নির্মিত হচ্ছে পাশ্চাত্য ধাঁচের বহুতল ভবন।
কিন্তু এরকম সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যেও প্রকৃত জাপানকে চেনা যায়। প্রকৃত জাপানই বাইরের মানুষদের প্রচ-ভাবে টানে। তেমনি একটা টান বা আকর্ষণবোধ করে প্রাচীন কিয়োটোর উজি নগরীতে অবস্থিত ‘দ্য গেঞ্জি মিউজিয়াম’ দেখতে যাই। একাদশ শতকে লেখা মুরাসাকি শিকিবুর গেঞ্জি উপন্যাসকে কেন্দ্র করে এই মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে। ছাত্রাবস্থায়ই পড়েছিলাম বিশ্বসাহিত্যের প্রথম উপন্যাস গেঞ্জির কাহিনি জাপানে লেখা হয়েছে এবং ঔপন্যাসিক একজন নারী। তাই কৌতূহল ছিল প্রচ-। উজি নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা মিউজিয়ামটি সারাবিশ্বের মানুষের কাছে অভাবনীয় আকর্ষণের বিষয়। লক্ষ-কোটি মানুষ স্থানটি পরিভ্রমণ করে। আকর্ষণের আরেকটি কারণ চা-উৎসব। উজি নদীর অপর পাড়ে, ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। দুই আকর্ষণেই প্রতিবছর দশ থেকে বিশ লাখ মানুষ ওই স্থানগুলো পরিভ্রমণ করে। সেখানকার এক পর্যটন কর্মকর্তা পাওয়ার পয়েন্টে আমাদের দেখিয়েছেন ওই বৎসর জুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দশ লাখের কাছাকাছি পর্যটক মিউজিয়ামটি পরিদর্শন করেছেন। উজিতে ‘গেঞ্জি’ মিউজিয়াম স্থাপনের কারণ উপন্যাসটির শেষ দশ অধ্যায়ের পটভূমি হচ্ছে উজি। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী উজি নগরীর মানুষ পুরনো জাপানি আবহে নিজেদের গৌরবময় কৃষ্টি আঁকড়ে থাকতে পছন্দ করে। সেখানকার সব বাড়িঘরই প্রাচীন জাপানি আদলে নির্মিত। পরিবেশ-আবহ যেন কবি কালিদাসের সে উজ্জয়িনী, প্রাচীন নগরী।
মুরাসাকি শিকিবুর গেঞ্জির কাহিনিই মূলত জাপানি উপন্যাস সম্পর্কে আমার আগ্রহের সৃষ্টি করে। বৃহৎ কলেবর, উপন্যাসের রচনাকাল, পটভূমি, বিষয়বস্তু, দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আমাকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয় লেখিকার চিন্তাশক্তি, লেখার সাহস, হেইয়ান সম্রাটদের অন্তঃপুরের ঘটনা ও কাহিনিকে উপন্যাসে রূপায়ণ এবং ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর অবতারণায় চরিত্রগুলোর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, ভোগমানসিকতার নৈতিক পরিণতি (বিপর্যয়) কোনো ধর্মীয় বক্তব্য ছাড়াই Ñ ভাবা যায়? সম্রাটের স্ত্রী অর্থাৎ সম্রাজ্ঞীর সহচরী হওয়া সত্ত্বেও সম্রাট-সম্রাজ্ঞী তোষণের একটি শব্দও ব্যবহার করেননি তিনি। বরং কল্পিত কাহিনি এবং চরিত্রে প্রাসাদের সবাই আছেন ভিন্ন নাম-পরিচয় এবং নিজেদের সকল নৈতিক-অনৈতিক কর্মকা-ের বাস্তব চালচিত্র নিয়ে। প্রাচীন সাহিত্যের যা প্রধান বিশেষত্ব, সে ধর্মীয় দেবদেবীর কথা নেই, আছে বাস্তবের মানুষ, চারপাশের রক্ত-মাংসের মানুষ, শিকিবু যাদের প্রতিদিন দেখেন এবং গভীর থেকে উপলব্ধি করেন।
আধুনিককালের জাপানি উপন্যাস চিন্তা ও আঙ্গিকভাবনায় বেশ অগ্রসর। এই আধুনিকতার সূচনা হয় মেইজি পর্বে (১৮৬৮-১৯১২)। তখন বিদেশি সাহিত্য অনূদিত হয়ে জাপানে আসে। গেঞ্জি উপন্যাসের সাত-আটশো বছর পরও জাপানের উপন্যাস প্রত্যাশিতভাবে অগ্রসর হয়নি। আধুনিক জীবনের প্রতিফলন আছে এরকম রুচিকর উন্নত উপন্যাস মধ্য-উনিশ শতকেও লেখা হয়নি, শেষ দুই দশকের কিছু নিদর্শন দেখা গেছে। পরবর্তী সময় অর্থাৎ বিশ শতকে অভাবনীয় সাফল্য আসে। বিশ্বমানের উপন্যাস লেখা হয় তখন। পাশ্চাত্য উপন্যাসের মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করে এসব উপন্যাস।
মাঝখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাপানকে আমূল ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সাহিত্য-উপন্যাস কিছুই রক্ষা পায়নি। নতুনভাবে সংকটের সৃষ্টি করে জাপানের পরাজয় এবং জাপানি সৈন্যদের যুদ্ধকালীন ফিলিপিন এবং কোরিয়ায় পরিচালিত হত্যা-ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। জাপানের বুদ্ধিজীবী এবং লেখকেরাই এজন্য বেশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকে কাওয়াবাতা উপন্যাস লিখতেন। যুদ্ধোত্তরকালে যে উপন্যাস লিখলেন তার বর্ণনা দিলেন ‘বিলুপ্ত জাপানের শোকগাথা’ বলে। যুদ্ধে পরাজয় এবং দিশা হারিয়ে বিভ্রান্ত লেখকদের কেউ কেউ ব্যর্থতা ও হতাশা কাটিয়ে নতুন জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কোনো কোনো লেখক অতীত ঐতিহ্যে অবগাহনের মধ্যে সুখ অনুসন্ধান করেছেন।
যুদ্ধোত্তর জাপানের ‘প্রথম প্রজন্মের লেখক’রা যুদ্ধের আগেই সাহিত্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর পরিবর্তিত পরিবেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক এবং সামাজিক প্রেক্ষিতগুলো উপন্যাসে বিশ্লেষণের জন্য এঁরা এগিয়ে এলেন। তাঁদেরই একজন যুদ্ধের ওপর লেখা উপন্যাসে ফিলিপাইনে জাপানি সৈন্যদের অমানবিক আচরণের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেন।
যুদ্ধোত্তর জাপানের ‘দ্বিতীয় প্রজন্মের লেখক’দের মধ্যে শক্তিশালী দুজন ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব ঘটে। এঁরা দুজনই রাজনৈতিক সচেতন এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। একজন ডানপন্থী মিশিমা, অপরজন বামপন্থী আবেকোবো। একজন সম্রাটের শাসন অর্থাৎ জাপানের অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চান। অপরজন পরাবাস্তববাদী চিন্তায় নান্দনিক জাপানের অস্তিত্ব খোঁজ করেন। বৈশ্বিক মানদ-ে এঁরা দুজনই শ্রেষ্ঠ লেখক।
জাপানের ‘তৃতীয় প্রজন্মের লেখক’রা উঠে আসেন অপেক্ষাকৃত সুবিধেজনক পরিবেশে। তাঁদের মধ্যে একজন নোবেল পুরস্কারও পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতগুলো তাঁর (ক্যানজাবুরো ওয়ে) চিন্তায় নিরপেক্ষ ভাবনার পথ তৈরি করে।
সর্বশেষ যে লেখক জাপানকে বিশ্বে আলোকিত করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন, সেই পরাবাস্তববাদী লেখক হারুকি মুরাকামি নিরন্তর নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন। তাঁর উপন্যাসে জীবন-আচরণ ও সামাজিক ইস্যুসমূহে উত্থাপিত বিষয়গুলো ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের গ্রন্থি-উন্মোচনে জটিল পথে পা বাড়িয়েছে। তারপরও পাঠক তাঁর লেখা পছন্দ করছেন। তাঁর বই প্রকাশিত হওয়ার আগেই সারাবিশ্বে প্রচুর মাতামাতি হয়। পত্র-পত্রিকাগুলো নানারকম আগামবার্তা প্রচার করে। বই প্রকাশের পর লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। উৎসাহী পাঠক লাইন ধরে দাঁড়িয়ে সারারাত জেগে থেকে বই কেনে Ñ যা দেখা যায় আমাদের দেশে ঈদের আগে রেলস্টেশনগুলোয়। এখানে অপেক্ষমাণ জনতা বই নয়, ট্রেনের টিকিট চায়।
জাপানি ঔপন্যাসিকদের দুজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দু-তিনজন পাই পাই করে পাননি। একজন অপেক্ষায় আছেন। এসব প্রমাণ করে জাপানি উপন্যাস কতটা এগিয়ে গেছে এবং কোথায় তার অবস্থান। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান অর্থনৈতিকভাবে বাকি বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করছে – উপন্যাসেও সেরকম চ্যালেঞ্জ জানাবার মতো ক্ষমতা রাখে, এ কথা বললে বোধহয় বেশি ভুল বলা হয় না।
এই গ্রন্থে সাতটি প্রবন্ধ রয়েছে। পরিশিষ্টে আছে আরো একটি। ছয়টি প্রবন্ধ জাপানের শ্রেষ্ঠ ও বিশ্ববিখ্যাত বলে বিবেচিত ছয়জন ঔপন্যাসিকের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পরিশিষ্টের প্রবন্ধটি মূলত দুটি বইয়ের আলোচনা। একটি বইয়ের লেখক জাপানের বাইরের বলে প্রবন্ধটি পরিশিষ্টে রাখা হয়েছে। প্রথম প্রবন্ধটিতে জাপানি উপন্যাসের পটভূমির সঙ্গে একটি সার্বিক পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে। সবকটি প্রবন্ধই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত। উল্লেখ্য, মিশিমাকে নিয়ে আমার লেখা একটি উপন্যাস ২০১৬ সালে প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। উপন্যাসটির নাম মিশিমার সুইসাইড নোট।
প্রবন্ধ-গ্রন্থের পা-ুলিপি তৈরিতে সাহায্য করেছেন মোহাম্মদ আতাউল হক ভূঁইয়া এবং আমার স্থপতি পুত্র ফাহিম হাসিন সহন। গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে ————- আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। প্রবন্ধ-গ্রন্থটিকে নির্ভুল করতে চেষ্টার কমতি ছিল না। তারপরও কিছু অনভিপ্রেত ত্রুটি রয়ে গেছে। পরবর্তী সংস্করণে ত্রুটিগুলো সংশোধনের ইচ্ছে রইল।



Buy this book from:



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *