
নির্বাচিত নিমপ্রবন্ধ
ফেরদৌস আরা আলীম
প্রথম প্রকাশ : অক্টোবরর ২০১৩
মূল্য : ৩৫০ টাকা
ফেরদৌস আরা আলীম-প্রণীত ‘নির্বাচিত নিমপ্রবন্ধ’ নামের গ্রন্থে দরকারি কিছু প্রবন্ধই সংকলিত হয়নি, এখানে তিনি যেন নিজের ব্যক্তিত্ব উদযাপন করছেন। তাঁর বলার জাদুকরী মোহনীয়তায় একধরনের মুগ্ধতার চাষাবাদ করেছেন। তাতে প্রবন্ধ আছে তেইশটি, সবগুলোর ভেতরই ভাষার মমতা আছে, আছে নিজেকে প্রকাশের একমুখী বাসনা। আমরা যদি এ-প্রবন্ধগ্রন্থকে একটা বিচারালয়ের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে তার বলার ধরনটা হচ্ছে – তিনি বাদীর পক্ষে অনবরত তার নিজস্ব সাধনার কথা, মতপ্রকাশের কথা, এমনকি ব্যক্তিত্ব লালনের কথা বলে গেছেন। তাঁর প্রকাশের ধরনটি চমৎকার। তাতে ফাঁক-ফোকর তেমন আছে বলে মনে হয় না এবং তা ভাষিক মজায় পরিপূর্ণ।
তাঁর সৃজিত প্রথম নিমপ্রবন্ধ হচ্ছে ‘আমি বাঙালি’, যেখানে তিনি তাঁর জাতিসত্তা প্রকাশের একটা ধারণা বিকশিত করছেন। আমরা জানি যে, ভাষা-এলাকা-বোধ-ধর্ম নিয়ে নানাধরনের জাতিসত্তা প্রকাশ পায়। তিনি কার্যত ভাষার ওপরই তার জাতিসত্তার বিকাশ চান। তাতে আরো প্রকাশ পায় আমাদের সংস্কৃতি, সনের হিসাব যেখানে শাস্ত্র আর ধর্মের বিষয়টি তিনি দেখতে চান না, সেখানে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রকাশই মুখ্য। বৈশাখের প্রথম দিনকে তিনি মর্যাদা দেন, সাহিত্যমেলা আর কাব্যিক আবহ তাঁকে প্রশান্তি দেয়। পুণ্যাহ নামের জমিদারি বিষয় নয়, তা যেন এখন জনসংস্কৃতির দ্বারে চলে আসছে, তা সাহিত্যমেলার সতীর্থ মনে হয়। এভাবেই প্রতিদিনের প্রতি, কাজের প্রতি, মুহূর্তে বাঙালিত্বের প্রতি, তিনি দায়ী থাকতে চান।
তারপরই যার জন্য লেখক ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’ পেতেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর সার্ধশত জন্মবছরের এক অনুষ্ঠানের কথা লিখেছেন। দুদিনব্যাপী সেই অনুষ্ঠান প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে পালিত হয়, যেখানে তাঁর কথাসাহিত্য, কবিতা, গান, চিত্রকলা, নাটক, মনুষ্যত্ব, জাতিভাবনা ও শিক্ষাভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। তাতে বিভিন্ন পর্যায়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, হায়াৎ মামুদ, আকবর আলী খান, ড. মালেকা বেগম, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, ওয়াসি আহমেদ, আনিসুল হক প্রমুখ আলোচনা করেন। দুদিনের এ-আয়োজনে রবিঠাকুরের প্রায় সবদিকই অতিআনুষ্ঠানিকতায় আলোচিত হয়। এতে আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও মানবিক মূল্যবোধের অনেক দিকই আমরা পাই। কাজী নজরুলের সার্ধশতজন্মবার্ষিকী উদযাপনের তাড়নায় তিনি লিখেছেন ‘কবি নজরুলের সার্ধশতজন্মবর্ষের অপেক্ষায়’ নামের প্রবন্ধ। এতে নজরুলের সাহিত্য-শিল্প, বিশেষত সাংস্কৃতিক নানান কর্মযজ্ঞের তিনি বর্ণনা করেছেন।
অতঃপর আমরা পাঠ করি জীবনানন্দ দাশকে, তাঁর প্রবন্ধের নাম ‘ভুল পৃথিবীর এক শুদ্ধ কবি’। এর ভাষাও যেন জীবনানন্দের মায়াময়তা দিয়ে নির্মিত। আমরা হেমন্তের এই কবিকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে এখানে পাই। বরং একজন জীবনানন্দকে যেন দারুণ তৃষ্ণা নিয়ে পান করতে থাকি। তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে জানি, তাঁর সলাজ অবস্থান দেখি, পারিবারিক বিষয় সম্পর্কেও জানতে থাকি। কোনো চাকরিই তাঁকে শান্তি দেয়নি, তা যেমন সত্য, কোনো পারিবারিক অবস্থানই তাঁকে শান্তিতে রাখেনি এটাও তেমনি সত্য। তার এই যে যন্ত্রণা, সাহিত্যিক এই যে অতৃপ্তি, কথিত ভুল জগতের একটা বাসনা আমরা লেখকের কথনে পাই। এখানে লেখক জীবনানন্দ নামের মানুষটির সহপ্রেমী, তার যাতনায় একেবারে নিমজ্জিত লেখক। এভাবে দেখার ধরনটিও আমাদের কাছে নতুন মনে হতে পারে। এই প্রেম, এই মুগ্ধতা কবিকে নতুন প্রাণ দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পরবর্তী প্রবন্ধটি পাঠ করি, যার শিরোনাম ‘কবিমাতা নিজেই যখন কবি’। এটি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাসকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। এরপর রয়েছে ঝাঁঝালো প্রবন্ধ ‘তাহার জীবন তাহার ছিল না, তাহার গল্পও তাহার ছিল না’। এটি যেন এক প্রতিবাদ, এক পোস্টার যেন, নারীকে অবদমনের, নির্যাতনের, থরো থরো কম্পন-ইতিহাসের এক দীর্ঘ বয়ান। আমরা এখানে নারী নির্যাতনের কথা, তাকে দাবিয়ে রাখার নানান ঘটনা ও কাহিনি শুনি। নারীবাদও এখন এক প্রতিবাদী স্তরেই আছে। তবু নারীর ওপর নির্যাতন, তাকে মানুষ মনে না-করার গল্পও অহরহ জমা হচ্ছে। তাই তিনি তাঁর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লেখাটি লিখেছেন। তাতে নারীবাদ, বেগম রোকেয়া, সেলিনা হোসেন, পূরবী বসু, নাসরীন জাহান এমনকি জেসমিনের ইচ্ছাপূরণের কথাও তিনি বর্ণনা করে গেছেন। তাঁর বলার ভেতর দিয়ে একটা ভয়ংকর চিত্র আমরা পাই। আমরা হকচকিত, বিহ্বল, এমনকি প্রতিবাদমুখরও যেন হই। ‘নারীর কলম, এখন-তখন’ নামের প্রবন্ধে তিনি নারী-লেখকদের একটা যথার্থ ইতিবৃত্তই দাঁড় করিয়েছেন। তাতে দশক হিসাব করে তিনি নারী-লেখকদের পরিচয় করিয়েছেন। তাতে আমরা একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাস পাই। তাঁদের যন্ত্রণা, সংগ্রাম, দ্রোহ দেখি। মহাশ্বেতা দেবীকে নিয়ে ‘মহাশ্বেতা দেবীর এটি বর্ষার্ত গল্প নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ’ নামের প্রবন্ধে এই সংগ্রামী, মায়াময়, রোদনকাতর, তথ্যপিপাসু সাহিত্যিকদের নানান দিক তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক ইতিহাসকে এত জনসমক্ষে আর কোনো কথাশিল্পী এনেছেন বলে আমাদের জানা নাই। মাহমুদুল হককে নিয়ে একটা সারগর্ভমূলক প্রবন্ধ তিনি দাঁড় করিয়েছেন, যার শিরোনাম- ‘মাহমুদুল হক ও তাঁর কথাশিল্প’। মাহমুদুল হক শুধু ভাষার জন্য নন, সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচনেরও তিনি কারিগর। তাঁর লড়াইটা ছিল প্রগতিশীল সাহিত্যগোষ্ঠী নামের যে টানটান উত্তেজনামুখর একটা ধারা ছিল তার বিপরীতে। তিনি মুরিদ বা গোষ্ঠী খোঁজেননি, কারো কাছে নিজের দর্শন বিসর্জন দেননি। তিনি আনন্দময় মুক্ততার এক ধ্বজাধারী ছিলেন। এ-লেখক আরেকটি অত্যন্ত সাহসী প্রবন্ধ লিখেছেন ‘মালতীর পক্ষে’ নামে। বুদ্ধদেব বসুর রাত ভ’রে বৃষ্টি নামের প্রবন্ধের মালতীর নারীস্বাধীনতা, যৌনতার মুক্তি, তার ভালোবাসা, বিকল্প জীবন নির্মাণের পক্ষেই তিনি কথা বলেছেন। এভাবে আমরা এক দরকারি বিকল্প কথনভাষ্য পাই। বন্ধুত্বের আরেক দিক প্রকাশ পেয়েছে ‘একটি সামাজিক সত্য ও আবু সয়ীদ আইয়ুব’ নামের প্রবন্ধে। এখানে তিনি বন্ধুত্বের এক নতুন নজির হাজির করেছেন, যেখানে আবু সয়ীদ আইয়ুব স্বামী-স্ত্রীর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুত্বের নমুনা হাজির করেছেন। মানসী রায়কে ঘিরেই এই সমজাল আমরা দেখি। ‘অগ্নিদীপ্ত এক অন্ধকার জীবনের গল্প’ নামের প্রবন্ধে শহীদ সাবেরকে দিয়ে অতিঅনুসন্ধানী হৃদয়বিদারী জীবন দেখিয়েছেন লেখক। এখানে সংবাদ পত্রিকাকে ঘিরে প্রগতিশীল জীবনের অনেক কথাই উঠে এসেছে।
চট্টগ্রামের লোকসংগীত আমাদের জাতীয় জীবনেরই এক সাংস্কৃতিক সম্পদ, যা এই লেখক ‘আমাদের লোকসঙ্গীত : প্রেক্ষিত চট্টগ্রাম’ নামের প্রবন্ধে দেখিয়েছেন। এভাবে আলাউলের কবিভাষা আর আবদুল হক চৌধুরীর জীবনও তিনি বয়ান করেছেন। এতে যথাক্রমে আলাউলের ভাষামাধুর্য আর চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি, ভূগোল, কাব্যসৌকর্য প্রকাশ পেয়েছে। ছোটকাগজ নিয়ে তিনি একটা আবেগমুখর লেখাও তাতে যুক্ত করেছেন। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনকে নিয়ে ‘গড়ানো দিনের গল্প’ নামের তথ্যধর্মী একটা লেখা এখানে আছে। তাতে তিন বিঘা করিডোরের নানান বিষয় অনেকটা পরাবাস্তববাদী আবহে লেখক সৃজন করেছেন। তবে সেখানকার যাপিত জীবন, চিকিৎসাসংকট, চোরাকারবার ও স্বাধীনতার প্রথম নিশান উড়ানোর গৌরব নিয়ে কথা থাকতে পারত। মোতাহার হোসেন চৌধুরী, জ্যোতির্মালা দেবী, এবং সবশেষে নারী-লেখকদের নিয়ে একটা লেখা দিয়ে শেষ করেছেন তার এ-গ্রন্থ।