
রবীন্দ্রস্মৃতি
‘রবীন্দ্রস্মৃতি।’ চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরীর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরে স্মৃতিচারণমূলক রচনার সংকলন। চিত্রনিভার কন্যা বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ড. চিত্রলেখা চৌধুরী যত্ন ও মমতাস্নাত সম্পাদনায় এই বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস লিমিটেড বাংলাদেশ থেকে।
চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরীর জন্ম ১৯১৩ সালে বাংলাদেশের চাঁদপুরে। তাঁর আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ নাম রাখলেন চিত্রনিভা। এর আগে তাঁর নাম ছিল নিভাননী। শান্তিনিকেতনের কলাভবন থেকে পাশ করে কবির নির্দেশে এবং নন্দলাল বসুর পরামর্শে প্রথম মহিলা শিক্ষক হিসেবে কলাভবনেই কাজ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায় যাঁর সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলার বিকাশ, শান্তিনিকেতনের সব অতিথির মুখ যিনি ধরে রেখেছেন রেখায় রঙে, ধরে রেখেছেন সাঁওতালদের বিয়ের অনুষ্ঠান, ঘরকন্না, যাঁর আঁকাগুলো মহিলা শিল্পী নামের থেকে অনেক দৃঢ় আর ঋজু; তাঁর ছবি হারিয়ে গেলে ফাঁক থেকে যাবে রবীন্দ্রবীক্ষণে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও যাঁর তুলি বিশ্রাম নেয়নি, মেয়েলি কুলোবরণ ডালা, পট কলস তাঁর তুলির ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল চিত্রনিভার। তাঁর স্মৃতিকথায় আমরা তাঁর অকপট-কথনের ভিতর দিয়ে এমনিভাবে তাঁর একান্ত কাছের মানুষ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অজ্ঞাত ও অল্পজ্ঞাত অনেক তথ্যই উঠে আসতে দেখি, যার ভিতর দিয়ে সমগ্র মানুষটির ব্যক্তিত্ব, রসবোধ, সচেতনতার সঙ্গে পিতৃস্নেহের ফল্গুধারা বয়ে যেতে দেখা যায়।
বইটির শুরু হয়েছে ‘আমার ধ্যানের ঋষি রবীন্দ্রনাথ, আমার ধ্যানের আশ্রম শান্তিনিকেতন’- এই শিরোনামের রচনা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথই যে তাঁর লেখার প্রেরণা তার ইঙ্গিত যেমন এখানে পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি শীর্ণকায় বইটি জুড়েই যে শান্তিনিকেতনের তপোবন সুলভ প্রেক্ষিতটা পাওয়া যাবে তা-ও আভাসিত হয়েছে। যেমন সদ্য পরিণীতা নিভাননী একদিন সন্ধ্যায় শরৎকালীন পূজাবকাশের মধ্যে শান্তিনিকেতনের অপরিচিত মানুষজন, অচেনা পথঘাটে সমন্ধিত আশ্রমে এসে পৌঁছালেন। আশ্রমের স্কুল বোর্ডিং সবই তখন বন্ধ থাকায় তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল উত্তরায়ণে ‘কোনার্কে’ কবির বাড়িতে ছোট্ট একটি ঘরে। কবির বাড়িতে তখন পরিচারক, পরিচারিকা ছাড়া কেউই না থাকায় কিশোরী মেয়েটিকে বিনা কাজে নিঃসঙ্গভাবে কাটাতে দেখে কবির পিতৃহৃদয় ব্যথিত হত বলে প্রতিদিন প্রভাতবেলায় মেয়েটিকে সিঁড়িতে একাকী বসে থাকতে দেখে স্নেহভরে আশীর্বাদ করে যেতেন। তারপর একদিন তাঁর এক পরিচারিকার সঙ্গে চিঠি লিখে নিভাননীকে পাঠিয়ে দিলেন নন্দলাল বসু এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে শিক্ষার জন্য। কাজেই ছুটিতেই নিভাননীর শিক্ষা শুরু হয়ে গেল। এইভাবে শান্তিনিকেতনের শুরুর দিনগুলি থেকেই প্রতি প্রভাতে ঋষি রবীন্দ্রনাথের দর্শন ও স্নেহস্পর্শে সিক্ত হয়ে কবিগুরুর আশীর্বাদধন্য নিভাননী রূপান্তরিত হলেন পরিবর্তিত পরিচিতি চিত্রনিভাতে।
রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এই স্মৃতিকথায় ছড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের বহু মূল্যবান কথা, বন্ধুদের কথা, অসুখের কথা, ছবি আঁকার কথা আরো কতো কী! সেইসব কথা আমরা জানতে পারি এই বইতে। বইটির শেষের দিকে সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জির আগে আছে চিত্রনিভার জীবন ও কর্ম নিয়ে ড. সোমা সেন রচিত দীর্ঘ একটি রচনা।
জীবনের নানা অনুষঙ্গের মধ্যে শান্তিনিকেতনের প্রতিনিয়ত বয়ে চলা প্রবহমান এক খরস্রোতের মধ্যে কতদিনের কথা হারিয়ে গেছে চিত্রনিভার মন থেকে তবু বিস্মৃতির সাগর থেকে যেটুকু উদ্ধার করতে পেরেছেন তাই দিয়ে তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে যে স্মরণ-মালিকা গেঁথেছিলেন তারই একটি সম্পাদিত ও বর্ধিত রূপ আজকের এই ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ বইটি।