
কালের সাক্ষী
এ সময়ের একজন অত্যন্ত অগ্রণী প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কালের সাক্ষী’। বইটিতে অন্তর্ভুক্ত দশটি প্রবন্ধের দিকে তাকালে বোঝা যায়, প্রতিটি রচনাজুড়েই রয়েছে প্রবহমান কালের নানাবিধ সাক্ষী ও সাক্ষ্য সম্পর্কে আলোচনা। লেখক শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর নোবেল বিজয়ের প্রসঙ্গটি দিয়ে, শুরু করেছেন নিজের একটি আত্মসাক্ষ্যরূপী স্মৃতিচারণধর্মী গদ্যরচনার মাধ্যমে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতা এ থেকে টের পাওয়া যায়। আর প্রতিটি লেখার মধ্যেই রয়েছে এই উপমহাদেশের ইতিহাসের ও সংস্কৃতির অতীত বা বর্তমান সময়ের রুদ্ধশ্বাস টানাপড়েনের উত্তাপ, এবং সেই উত্তাপের বিশ্লেষণেও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পাণ্ডিত্য ও স্বাতন্ত্র্য মণ্ডিত ভাবনার যথেষ্ট পরিচয় রেখেছেন।
বইটির প্রথম প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারে’ প্রায় অর্ধশত পৃষ্ঠা জুড়ে আলোচিত হয়েছে গীতাঞ্জলির ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের বিলাত-ভ্রমণের ইতিকথা, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সমকালীন রাজনীতি, ইয়েটসের গীতাঞ্জলিযোগসহ তৎসংশ্লিষ্ট বহু প্রসঙ্গ। এখানে লেখকের সাহিত্যবোধ ও রাজনীতি-সচেতনতা যুগপৎ তীক্ষèতায় নতুনভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবনের সেই বহুধাজটিল সময়টিকে অনুপুঙ্খরূপে পাঠকদের সামনে হাজির করেছে।
‘ম্যান্ডেলা, গান্ধীবাদ ও জনমুক্তির আকাক্সক্ষা’প্রবন্ধে লেখক প্রয়াত জননেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জীবন ও রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে গান্ধীবাদের সম্পর্কের যে-কথা শোনা যাচ্ছে, তার দিকে নতুনভাবে আলোকপাত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ম্যান্ডেলা একান্তই বস্তুবাদী ছিলেন, অপরপক্ষে মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ভাববাদী। গান্ধী যেখানে নেহাতই বিরতি দিয়ে নরম সুরে সমাজ ও শাসক পরিবর্তনের পথে হেঁটেছেন, সেখানে ম্যান্ডেলা ছিলেন অব্যাহত জনগণের আন্দোলনে বিশ্বাসী। ম্যান্ডেলা গান্ধীর কাছে তাঁর ঋণের কথা স্বীকার করেছেন বটে নানা লেখায়-বক্তৃতায়, কিন্তু তাঁর হাতে গড়া সংগঠনটি ‘গান্ধীবাদী আপসকামিতা ও শাসকশ্রেণির হৃদয় পরিবর্তনের ভদ্রলোকী বলয়’ থেকে নিজেদের বিযুক্ত রাখতে পেরেছিলেন বলেই সফল হয়েছিলেন।
এ-বইয়ের সবচেয়ে জরুরি ও অভিনব প্রবন্ধ যদি বলি ‘তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন’কে, তাহলে আশা করি অত্যুক্তি হবে না। তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবনের সাফল্য ও অবদান সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি কেন তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন ও কোন ধরনের রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ছিল এই দুটি প্রশ্নকে মাথায় রেখে লেখক এখানে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। তাজউদ্দীনের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন সময়ের তাগিদকে, কেননা তাঁর মধ্যে ছিল সংবেদনশীলতা ও কর্তব্যজ্ঞান তথা দায়িত্ববোধ। আর তাঁর রাজনীতি ছিল জাতীয়তাবাদের পটভূমিতে দাঁড়ানো ঠিকই, কিন্তু জাতীয়তাবাদের মধ্যে থাকা দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে তাঁর মতের মিল ছিল না, তিনি দাঁড়িয়েছিলেন জাতীয়তাবাদের মধ্যে বামপন্থীদের সীমান্তে। তাই তাঁর রাজনীতি ছিল ব্যক্তিগত মুনাফার নয়, সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি ইতিহাস ব্যক্তির সীমাকে নির্দিষ্ট করে দিতে চাইলেও কেউ কেউ তার মধ্যে থেকেই ইতিহাসকে বদলানোর চেষ্টা করে যান, ‘তাজউদ্দীনও তেমনটাই করেছেন’।
‘কাজী নূর-উজ্জামানের অসমাপ্ত যুদ্ধ’ মূলত মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত কাজী নূর-উজ্জামানের নির্বাচিত রচনা নিয়ে প্রকাশিত একটি বইয়ের ভূমিকা হিসেবে লিখিত। নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থের জন্য লেখা ভূমিকা হলেও এখান থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধার আজীবনের সংগ্রামের ও চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় বিস্তারিত আকারে।
‘পিয়ারু সরদারকে স্মরণ করি’ লেখাটি বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের ঢাকা শহরের বাইশজন পঞ্চায়েত সরদারের একজন, পিয়ারু সরদারের প্রতি একটি অনুপম শ্রদ্ধার্ঘ্য। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় যিনি পেশায় ছিলেন একজন সরকারি ঠিকাদার, তবু পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি ভাষাশহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য দরকারি সামগ্রী অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন প্রগতিমনা ছাত্রদের মাঝে। ছাত্রনেতাদের হাতে দিয়েছিলেন তাঁর গুদামের চাবি, নিঃস্বার্থভাবেই। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় ছিল, কিন্তু তিনি দ্বিধা করেননি।
‘ত্বকীর কবিতা-লেখা’ ঘাতকের হাতে নিহত প্রতিভাবান কিশোর ত্বকীর নোটবইতে পাওয়া কবিতার আলোচনা শুধু নয়, এ-লেখাটি আমাদের সমাজ-রাজনীতিতে যে এক কৃষ্ণকায় হননের কাল এখন বিরাজ করছে, তারও এক নির্লিপ্ত-রক্তাক্ত খতিয়ান যেন। লেখক তাঁর কিশোরবেলার কথা বলেন, লেখেন, তাঁর সময়ে রাষ্ট্র অনেক সময় শত্রুতা করেছে, নিপীড়নের চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু তখনো অবধি তা গুপ্তঘাতকদের লালন-পালন করে চলেনি। এখন যেমনটা করছে, আর সেই গুপ্তঘাতকদের হাতেই প্রাণ দিতে হয় তাই ত্বকীর মতো স্বপ্নবান কিশোর-তরুণদের।
‘লোকসংস্কৃতির ভদ্র-অভদ্র চর্চা’য় লেখক ভিন্ন আঙ্গিকে স্মরণ করেছেন গণসংগীতের নায়ক হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে। তাঁর মতে, লোকসংস্কৃতির প্রথাগত চর্চায় একধরনের ভাবালুতা বা আধ্যাত্মিকতা রয়েছে, যা কিনা শেকড়ে ফেরার নামে প্রকারান্তরে ডেকে আনে পশ্চাদমুখী প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনাকেই। কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস লোকসংস্কৃতির অন্যতম মুখ্য উপাদান লোকসংগীতকে ব্যবহার করেন গণসংগীতের মধ্যেও। আধ্যত্মিকতামুখী লোকসংগীতের বাণীকে তিনি দেখান ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।
গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধ ‘ভূতে-পাওয়া একজনকে নিয়ে আরেকজনের কথা’ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে লেখকের আন্তরিক অবলোকনের স্মারকবিশেষ। উদ্যোক্তা ও কর্মী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মূল্যায়ন করতে লেখক যেমন ফিরে তাকিয়েছেন তাঁদের দুজনের সমকালের দিকে, তেমনিভাবে নিজেদের কর্মের হিসাবনিকাশ নিয়েও কথাবার্তা রেখেছেন। মত দ্বিমত আছে এ-রচনায়, আছে নিজের ও নিজের সময়ের আত্মসমালোচনাও। স্মৃতিকথার ভঙ্গিতে লেখা হলেও লেখাটি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের এক জটিল ও বহুবর্ণ সময়ের তীক্ষ ব্যাখ্যাও ধারণ করে রয়েছে এমনটা বলাই যায়।