
রাজনৈতিক আন্দোলনে বাংলার নারী (১৯০৫-১৯৪৭)
‘রাজনৈতিক আন্দোলনে বাংলার নারী (১৯০৫-১৯৪৭)’। বইটির লেখক রেজিনা বেগম। এটা মূলত তাঁর পিএইচডি গবেষণা সন্দর্ভ। বাংলাদেশে নারী সংক্রান্ত গবেষণা ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। শুধু বিষয় নির্বাচন নয়, প্রচুর প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে গবেষণাকৃত বিষয়ের সন্তোষজনক উপস্থাপনের কারণে বোঝা যায়, এই লেখিকার পরিশ্রম বিফলে যায়নি।
বইটি বিশ শতকের প্রথম থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময়কালের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অবিভক্ত বাংলায় নারীর রাজনৈতিক উন্মেষ ও নারীমুক্তি আন্দোলনে বাঙালি নারীর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার তাৎপর্যমূলক বিশ্লেষণ।
রেনেসাঁসের সময়ে সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও নতুন যুগের সূচনা ঘটে। এই প্রগতিশীল ধারার শিল্প-সাহিত্যেও নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলার নারীসমাজে এভাবে শিক্ষার বিস্তার, শিল্প-সাহিত্য চেতনা ও স্বদেশ-চেতনা বিস্তারের প্রয়াসের ফলে ধীরে ধীরে তাদের ভেতর বৃহত্তর জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটে। সরাসরি এই অঞ্চলের নারীরা রাজনীতিতে প্রথম অংশগ্রহণ করে ১৮৮৯ সালে। ১৮৮৯-এ বোম্বেতে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে সর্বপ্রথম দুজন বাঙালি নারী যোগ দেন। এঁদের একজন কংগ্রেস নেতা জানকীনাথ ঘোষালের স্ত্রী স্বর্ণকুমারী দেবী এবং অপরজন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পত্নী কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও এর পূর্বে ১৮৮৩ সালে ইলবার্ট বিল আন্দোলনে ছাত্রীসমাজ যুক্ত ছিল এবং কবি কামিনী রায়, লেডি অবলা বসু, সরলা দেবী প্রমুখ ছাত্রী এই আন্দোলনে যোগ দেন। তবে ইলবার্ট বিল আন্দোলনে বাঙালি নারীর এই অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ ছিল না, বরং সমর্থনসূচক ছিল।
আমাদের ইতিহাসে নারী যেন অনেকটাই অস্পষ্ট, অকীর্তিত ও অনুপস্থিত। বিশেষত একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয় নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে বাঙালি নারীর দীর্ঘকালের যে সংগ্রাম সেটি ইতিহাসে কিছুটা উহ্য থেকে যায়। এমনকি যে-কোনো আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিবেচিত হয়, এর মধ্য দিয়ে নারীর নিজস্ব যে অর্জনগুলি থাকে তা রয়ে যায় অন্তরালে। কোন পরিস্থিতি ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় রাজনৈতিক নারীর উন্মেষ হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণকে উপস্থাপন করাই বইটির মূল উদ্দেশ্য।
বইটিতে লেখক রেজিনা বেগম নিপুণভাবে যে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা হলো, উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলন নয়, বরং উপনিবেশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবার মধ্য দিয়েই বিশ শতকে বাঙালি নারীর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে; এবং একই সমান্তরালে সূত্রপাত হয় নারীমুক্তি আন্দোলনের। যুক্তির সারবত্তা প্রমাণে যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণ উপস্থিত করার ক্ষেত্রে লেখিকার শ্রমনিষ্ঠ প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে।