
শামসুর রাহমান ও বন্ধুত্ব
আধুনিক লেখকদের অভিন্নহৃদয়ের ‘লেখকবন্ধু’ পাওয়া যতটা কঠিন, বলা যায়, বন্ধুত্ব রক্ষা করা তার চেয়েও বেশি কঠিন। হয়তো এজন্যই সৃজনশীল অনেক লেখকেরই প্রকৃত লেখকবন্ধু নেই। তারপরও শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র-চারুকলাসহ সৃজনশীল নানা মাধ্যমে পাওয়া যায় বন্ধুত্বের গভীর ও অমলিন নিদর্শন। বিশ্বসাহিত্যের কথা থাক, বাংলা সাহিত্যেও বন্ধুত্বের নিদর্শন প্রচুর। শামসুর রাহমান ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর বন্ধুত্ব এমন এক রূপকথা যে, তাঁদের শিল্পযাত্রায় ওই বন্ধুত্ব যেমন একে অপরকে প্রাণিত করেছিল, তেমনই নির্মাণ করেছিল গভীর সংবেদী এবং শক্তিশালী চিন্তা ও মননের জগৎ। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর গ্রন্থ ‘শামসুর রাহমান ও বন্ধুত্ব’ পড়তে-পড়তে মনে হয়, দুজনের এই বন্ধুত্ব শুধু তাঁদের সাহিত্যজীবনেরই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নয়, বাংলা সাহিত্যের জন্যও বিরল ঘটনা।
বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক, প্রাবন্ধিক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘শামসুর রাহমান ও বন্ধুত্ব’ বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড। জীবদ্দশায় বইটির পাণ্লিডপি ও প্রচ্ছদ তিনি দেখেছেন, নিষ্ঠার সঙ্গে বইটির জন্য সময়ও দিয়েছেন, কিন্তু বইটির ভূমিকা লিখে যেতে পারেননি। দুই মলাটে প্রকাশের আগেই আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে নিয়ে গেছে না-ফেরার দেশে। তাঁর প্রয়াণের কিছুদিন পরই প্রকাশিত হয় এই বই, যার ক্ষুদ্রপরিসরে হৃদয়স্পর্শী একটি ভূমিকা লিখেছেন কালি ও কলম সম্পাদক এবং বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের নির্বাহী পরিচালক আবুল হাসনাত। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর রচনায়, বিশেষ করে, তাঁর বিশ্লেষণাত্মক গদ্যে উঠে এসেছে এই আদর্শবোধ।
শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের অনেকেই জানেন, বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং প্রাবন্ধিক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন হরিহর আত্মা। আমৃত্যু তাঁদের মধ্যে অটুট ছিল গভীর বন্ধুত্ব, শৈল্পিক হৃদ্যতা। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন থেকেই তাঁরা দুজন হয়ে উঠেছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু, শিল্পসহযাত্রী। দুজনের সৃষ্টিশীলতায়, সৃজনশীল কর্মকা-ে তাঁদের এই বন্ধুত্বের কথা উঠে এসেছে নানা ভঙ্গিমায়। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তাঁর বিভিন্ন রচনায়, স্মৃতিকথায়, কাব্যালোচনায়, সাহিত্য-সমালোচনায় তুলে ধরেছেন বন্ধু শামসুর রাহমানের সৃজনকর্ম এবং বন্ধুত্বের অপার মহিমা। কবি শামসুর রাহমানও লিখেছেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে নিয়ে নানা রচনা। তাঁদের বন্ধুত্বের ওই মহিমা প্রতিফলিত হয়েছে ‘শামসুর রাহমান ও বন্ধুত্ব’ শিরোনামের বইটিতে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন শামসুর রাহমানের কবিতার মুগ্ধ পাঠক ও বিশ্লেষক। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সাহিত্যবোধ এবং রুচি তাঁদের সখ্যকে আরো দৃঢ়, আনন্দময় করে তুলেছিল। শামসুর রাহমান আজীবন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতা-ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনই জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও বন্ধুর অভিমতকে গ্রহণ করেছেন হৃদয় থেকেই। বইটিতে শামসুর রাহমানকে নিয়ে আছে ভিন্ন স্বাদের পাঁচটি প্রবন্ধ। আছে স্মৃতিচারণামূলক রচনাও। তাতে ব্যক্তি শামসুর রাহমান ও তাঁর কবিতা-উপন্যাসসহ নানাধর্মী লেখালেখি নিয়ে আলোকপাত করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। রচনাগুলোয় সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে যেমন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর অতলস্পর্শী-দৃষ্টি প্রতিভাত হয়েছে, তেমনি উঠে এসেছে পঞ্চাশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণালি দিনের কথা, এসেছে মুক্তিযুদ্ধসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক কালপর্ব। এছাড়া আছে শামসুর রাহমানের প্রয়াণে বন্ধু-স্মরণে লেখকের শোকাঞ্জলি।
বইটিতে বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণ বেশি থাকলেও শিল্পসাহিত্য-সমাজ-শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে আছে অন্যান্য রচনাও। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল ফজলসহ কয়েকজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও বন্ধুকে নিয়েও আছে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ। এসব রচনা যেমন সুখপাঠ্য, তেমনই আকর্ষণীয়।
বইটির কিছু কিছু প্রবন্ধ স্মৃতিকথা ধাঁচের, তাতে যেমন ব্যক্তিক ভালোলাগা, মুগ্ধতা ফুটে উঠেছে, তেমনই লেখকের মুন্শিয়ানায় উঠে এসেছে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর গভীর প্রাজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার নির্যাস। কয়েকটি রচনায় উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের কথকতা। উঠে এসেছে কলকাতার স্মৃতি, এসেছে দেশভাগ, ছাত্ররাজনীতি, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতিকথা।