Deep Within the Heart
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ উপন্যাস কিংবা নাটক – সব ক্ষেত্রেই তাঁর বিচরণ ছিল সাবলীল ও দাপুটে। তাঁর সেইসব সাহিত্যকীর্তির মধ্যে অন্যতম সেরা একটি কাজ ‘পরানের গহীন ভিতর’ নামক কবিতার বইটি। পকেট সাইজের এ-বইটি তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় কবিতার বইও বটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে ‘এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।‘ এই লাইনগুলো আমাদের মুখে মুখে থাকত। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা তাঁর এই সনেটগুচ্ছ শেকড়ের অনেক কাছাকাছি থাকা একটি বই। আঞ্চলিক ভাষার টোনে এমন সার্থক রচনা বাংলা কবিতায় খুব কমই লেখা হয়েছে, কিংবা আদৌ হয়েছে কি? তাই তার এই বইয়ের বহুল পাঠ প্রয়োজন ছিল। অনুবাদক সোনিয়া আমিন এই অসামান্য বইটি অনুবাদের প্রয়াস দেখিয়েছেন। ইংরেজিতে অনুবাদক যার শিরোনাম দিয়েছেন, “Deep Within the Heart”. বলা বাহুল্য, এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদকর্ম নিঃসন্দেহে। সাধারণত বলা হয়ে থাকে, কবিতার অনুবাদ হয় না। তার ওপর এটি এমন একটি বই যা বিষয়বস্তু, আঙ্গিক এবং ভাষাগত দিক থেকে বেশ জটিল। এই বইয়ের অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রথমত ভাষাকে কিছুটা ছাড় দিতে হয়।কারণ, আঞ্চলিক ভাষার যে আবেদন তা অনুবাদে ধরাটা খুবই কঠিন। বইটি অনুবাদ করা তাই মোটেই সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু সেই কঠিন কাজটিই সোনিয়া আমিন করার চেষ্টা করেছেন অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জলভাবে। অনেক ক্ষেত্রে আক্ষরিক অনুবাদে না গিয়ে মূলের প্রতি অনুগত থাকার চেষ্টা করেছেন। কোথাও কোথাও আবার নিজের মতো করে শব্দ বাছাই করার মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন। যেমন এগার নম্বর সনেটে, “যখন ফুরায়া যাবে জীবনের নীল শাড়ি বোনা,” এই লাইনটির অনুবাদ করেছেন এভাবে, “when my life stops weaving its shimmering blue colth”. এখানে অনুবাদক ‘নীল শাড়ি’র অনুবাদে ‘blue sari’ এড়িয়ে গিয়ে shimmering blue colth ব্যবহার করেছেন, যা লাইনটিকে আরো বেশি প্রাঞ্জল করে তুলেছে। শুধু এই লাইনটিই কেবল নয়, আরো কিছু কিছু জায়গায় নিজের মতো করে স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদক সোনিয়া আমিন। তবে, সেই স্বাধীনতা কবিতাগুলোকে পাঠের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে না, বরং আরো বেশি স্বতঃস্ফূর্ত করে তুলেছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, অনুবাদক অহেতুক জটিল এবং অপরিচিত শব্দের ব্যবহার খুব সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। আবার কখনো কখনো কেবল কবিতার ‘এসেন্স’টাকেই অনুবাদক ধরতে চেয়েছেন। যেমন এই লাইনটি, “সকাল বিকাল গাড়ি, চক্ষু আছে তাই চক্ষে পড়ে;” এটি যখন অনুবাদ হয়, “I see as I have seen before, the trains”; কিংবা “অথচ ঘরেই থাকি, পোড়া ঘরে থাকতে পারি না।” সোনিয়া আমিন এর অনুবাদ করেছেন, “My wretched, loveless, empty lot.” বাহুল্য এড়িয়ে কত সহজেই না আসল কথাগুলো বলে দিয়েছেন অনুবাদক। আর আমরা যেন অনুবাদেই মূল দৃশ্যটাকেই অনুভব করতে পারি। এই বইয়ে সর্বমোট ৩৩টি সনেট রয়েছে। যা পড়লেই বোঝা যায়, অনুবাদক বেশ শ্রম ও সময় দিয়ে কাজটি করেছেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অনুবাদক করেছেন সেটি হলো, বইয়ের শেষে বেশ কিছু টিকা দিয়েছেন। যেখানে আঞ্চলিক শব্দ কিংবা এমন কিছু অনুষঙ্গ যা অন্য ভাষার পাঠকদের কাছে অপরিচিত হতে পারে তার ব্যাখ্যা দিয়ে দিয়েছেন। যা ভিনদেশী পাঠকের কাছে এই বইটিকে আরো বেশি মনোগ্রাহী করে তুলবে। সবমিলিয়ে সোনিয়া আমিনের অনুবাদের বইটি বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন নিঃসন্দেহে।